দরজায় কড়া নাড়াচ্ছে কুমিল্লা সিটি নির্বাচন। দিন যতই যাচ্ছে ততই আলোচনা বাড়ছে নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের সমীকরণ নিয়ে। নগরী জুড়ে এখন একটাই আলোচনা কে হচ্ছে কুমিল্লার নগর ভবনের অভিভাবক। সবার মনে একটাই প্রশ্ন এবারও কি বাজিমাত করবেন মনিরুল হক সাক্কু নাকি আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত।
আলোচনা হচ্ছে বহিষ্কৃত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নিজামউদ্দিন কায়সারকে নিয়েও। মূলত এবার মেয়র পদে পাঁচজন প্রার্থী থাকলেও সব সমীকরণ আবর্তিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত, বিএনপি হতে বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু ও নিজামউদ্দিন কায়সারকে ঘিরে। রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের অভিমত এই তিন প্রার্থীর কেউ একজনই হবেন কুসিকের নগরপিতা।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খানকে ৩৫ হাজার ভোটে হারিয়ে নগর ভবনে যান মনিরুল হক সাক্কু। সে নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকলেও দল হতে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নেন সাক্কু। দলে না থাকলেও বিএনপি ও জামাতের পূর্ণ সমর্থনই সাক্কুর নির্বাচনী বৈতরণী পারের সহায়ক ছিলো। এরপর ২০১৭ সালের দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা পান আফজাল খানের কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমা। আর মনিরুল হক সাক্কু এই নির্বাচনে লড়েন বিএনপির ধানের শীষে। এই নির্বাচনেও সাক্কু প্রায় ১১ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। সেসময়ে সাক্কুর পক্ষে একাট্টা ছিলো বিএনপি, তবে এবারের নির্বাচনে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিএনপি নির্বাচনে না আসায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হন মনিরুল হক সাক্কু, এই অপরাধে দল থেকে বহিষ্কার হন তিনি। এদিকে এবার স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নিজামউদ্দিন কায়সারও আছেন ভোটের মাঠে, তাকেও বহিষ্কার করেছে বিএনপি। এবার ভোটের লড়াইয়ে কায়সারের উপস্থিতি বিপাকে ফেলেছে সাক্কুকে। বিগত দুইবারের সমীকরণ উলটপালট হয়ে গেছে কায়সারের প্রতিদ্বন্দীতায়। কুমিল্লায় বিএনপির রাজনীতির দুইটি ধারা, একটির নিয়ন্ত্রণ মনিরুল হক সাক্কুর হাতে অপরটি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াসিনের হাতে। এই ইয়াসিনের শ্যালকই হলেন নিজাম উদ্দিন কায়সার।
মূলত কুমিল্লার বিএনপির সক্রিয় অংশটি হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিন ও নিজাম উদ্দিন কায়সারদের। যার ফলে বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কায়সারের পক্ষেই মাঠে আছেন। এতে সাক্কুর পাশে ওইভাবে দলীয় কর্মীরা নেই। তাই এবার এ সাবেক মেয়রের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া খুবই কঠিন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। স্বাভাবিকভাবেই নগরীতে বিএনপির যে ভোটব্যাংক আছে তাতে এবার সাক্কুর একক আধিপত্য থাকবে না, সে ভোটের বড় একটি অংশ চলে যাবে কায়সারের পকেটে। এতে সাক্কুর জন্য জয়ের সমীকরণ এবার অনেকটাই জটিল হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ইয়াসিন- সাক্কু গ্রুপের দীর্ঘদিনের দ্বন্দের ফলেই এবারের ভোটের মাঠে কায়সারের আবিভার্ব। তারা এবার সাক্কুকে ঠেকানোর জন্য বদ্ধ পরিকর। তাই সাক্কুকে জিততে হলে এবার জটিল সমীকরণ পার হয়ে আসতে হবে।
এদিকে নৌকার টিকেট পেয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত। আফজাল খানের পুত্র ইমরান খান দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়ন নিলেও শেষমুহুর্তে দলীয় হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপে সরে যার তিনি। সেহিসেবে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসাবে রিফাত সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। অনেকেরই ধারণা সাক্কু-কায়সারের ভোট ভাগাভাগি রিফাতের জয়ের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।
এসব বিষয়ে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আমি মানুষের জন্য কাজ করেছি। আমার ইশতিহারের ৭০ শতাংশ কাজ কমপ্লিট করেছি। মানুষের সেবা করেছি। এবারও মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছি। দলের আরো একজন প্রার্থী থাকায় জয়ের পথ কঠিন হবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কায়সার আমার ছোট ভাই। রিফাত ভাই আমার বড় ভাই। মানুষ যারে ভালো লাগবো তারে ভোট দিবে। জোরাজুরির কিছু নাই।
এসব বিষয়ে নিজামউদ্দিন কায়সার বলেন, সাক্কু রিফাত দুইজনেই একই দলের। শুধু প্রতীক ভিন্ন। তারা একজন বিশেষ ব্যক্তির প্রার্থী। যেই পাশ করে ওই বিশেষ ব্যক্তির লাভ। সাক্কুর দুর্নীতির অনেক প্রমাণ আছে। মানুষ লুটেরা শ্রেণীর কাউকে চায় না।
অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে চলছে প্রচারণা :
মঙ্গলবার আওয়ামীলীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত নগরীর মুরাদপুর এলাকায় পথসভায় অংশ নেন। এসময় তিনি বলেন, আমি মেয়র হতে পারলে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের দুর্নীতির সমস্ত কাগজ আমি বের করবো। এরপর আমি কুমিল্লার সবাইকে টাউনহলে ডাকবো। সবাইকে আমি বিগত মেয়রের দুর্নীতির শ্বেতপত্র দিবো।
মঙ্গলবার টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু প্রচারণা চালান নগরীর আদালত এলাকায় প্রচারণা চালান। এসময় নগরীর কান্দিরপাড়ে রূপায়ন টাওয়ারের নকশা অনুমোদনে ৮০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন ওনার বিরুদ্ধে উঠা এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সাক্কু বলেন, ‘এসব ভুল কথা। আমি শুনছি নৌকা প্রতীক আনতে ৬০ কোটি টাকা ঘুষ দিছে। আমি তো এই কথা বিশ্বাস করি না। দল যারে ভালো মনে করছে তারে নমিনেশন দিছে। রূপায়নের অভিযোগ থাকলে তারা বলুক। যে টাকা দিছে সে বলবে, যার টাকা তার তো জ্বলে না। যার টাকা না তাদের কেনো জ্বলে এইটা তো আমি বুঝিনা। এসময় স্থানীয় সংসদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে তিনি বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য তার অফিসে সাংবাদিকদের ডেকেছে, মসজিদের ইমাম, এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকদের উনি ক্ষমতাবলে ডেকে ইলেকশন নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে। এইটা উনি করতে পারেনা। এই কারণে আমি নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
মঙ্গলবার নগরীর ২২নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালান ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজামুদ্দিন কায়সার। এসময় তিনি স্থানীয় সংসদ আচরণবিধি মানছে না বলে অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনী আচরণ বিধি অনুযায়ী স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচন চলাকালীন সময়ে সামাজিক রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেনা। সোমবারেও উনি ওনার দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেছেন, এইটা উনি করতে পারেনা। স্থানীয় সংসদ সদস্য বিভিন্ন কমিটি, স্কুল- কলেজের কমিটিকে ডেকে এনে নৌকার পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য কমিটমেন্ট আদায় করছে, এইটা উনি করতে পারেনা। আমি নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানাবো স্থানীয় সংসদ আচরণবিধি অনুযায়ী উনি যতটুকু থাকতে পারে, তার বাহিরে উনি শুধু ভোটের দিন কুমিল্লা থাকবে তার আগে যাতে উনি কুমিল্লা থাকতে না পারে।
প্রসঙ্গত, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৫ জুন। কুমিল্লা সিটির তৃতীয় এ নির্বাচনে ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। এদের মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন। পুরুষ ভোটার এক লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ২ জন। এই নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৬ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১০৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ