ইফতার পর্যন্ত প্রাণে না মারার আকুতি জানিয়েও দিনদুপরে প্রকাশ্যে নির্মভাবে খুনের শিকার কক্সবাজার সদরের পিএমখালীতে আলোচিত মোর্শেদ আলী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি বহু অপকর্মের হোতা মাহমুদুল করিম ওরফে ওসি মাহমুদুল করিম অবশেষে কারাগারে।
মঙ্গলবার (৩১ মে) দুপুর দেড়টায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করলে বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল তা নামঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করে।
স্থানীয়রা জানান, মাহমুদুল করিম পিএমখালী ঘোলার পাড়া ৬নং ওয়ার্ড মৃত মোহাম্মদ ইলিয়াস প্রকাশ কালুর পুত্র। তার ভাই আলীর প্রভাব খাটিয়ে থানা থেকে শুরু করে সর্বত্র দালালি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, সালিশ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করেছে। বর্তমানে সে অঢেল সম্পদের মালিক। তার কালো টাকার কাছে সকলেই জিম্মি ছিলো।
পিএমখালীতে তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষ। চলতি বছরের ৭ এপ্রিল পবিত্র রমজান মাসে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে জমির পানি সেচ প্রকল্পের বিরোধকে কেন্দ্র করে মোর্শেদ আলীকে পরিকল্পিতভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে মাহমুদুল করিম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। অবশেষে সে আইনের আওতায় আসায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন পিএমখালীর সাধারণ মানুষ।
এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, পিএমখালীতে সন্ত্রাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন, লুটপাট, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষসহ নানা অপকর্ম যেন একরকম স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করেন পিএমখালীর বাসিন্দা মাহামুদুল করিম। মাহামুদুল করিম পিএমখালী ইউনিয়নের অঘোষিত ওসি হিসেবে বেশ পরিচিত। ওই ইউনিয়নের ৯০ ভাগ বিচার-সমাধান তার হাত ধরেই হয়। থানায় কেউ অভিযোগ বা মামলা করলে সেটারও সমাধান দেন তিনি। তার কথার বাইরে কেউ অভিযোগও করতে পারে না। সদর থানার সাথে তার যোগাযোগ বহু বছর আগে থেকে। যার কারণে পিএমখালীর ওসি হিসেবে তার বেশ খ্যাতি রয়েছে এলাকায়। সেই অঘোষিত ওসি এখন কারাগারে। মোরশেদ বলী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি মাহামুদুল করিম। পিএমখালী গোলারপাড়া গ্রামের দরিদ্র নৌকার মাঝি ইলিয়াস প্রকাশ ওরফে কালু মাঝির ছেলে করিম।
মোরশেদ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরালের ঘটনার পর মামলা হলে ওসি করিমসহ সন্ত্রাসীরা গা-ঢাকা দেয়ায় আগের তুলনায় কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন গ্রামবাসী। এদিকে সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যুবকদের একটি অংশ নিজেরাই বাহিনী গড়ে তুলছে। তাদের উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নেয়া। পাশাপাশি ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এক বাহিনী ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে আরেক বাহিনীর। এভাবেই দিনে দিনে গড়ে উঠেছে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী।
অভিযোগ উঠেছে- প্রকাশ্যে নির্মমভাবে মোরশেদ বলিকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাকে হত্যার আগে মামলা থেকে রেহাই পেতে থানা পুলিশের সাথে খুনিরা বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময় কন্ট্রাক্ট করেছিল। এমটাই দাবি করেছে মোরশেদ আলির পরিবার। যদিও কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি তদন্ত সেলিম উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।
সদর থানায় চাঞ্চল্যকর মোরশেদ বলি হত্যাকাণ্ডের মামলা দায়ের করেন নিহতের ছোট ভাই জাহেদ আলী। মামলায় ২৬ জনের নাম উল্লেখ ও ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মোরশেদ বলি পিএমখালী মাইজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মৃত মাস্টার ওমর আলির ছেলে।
এদিকে মোরশেদকে হত্যার ওপরের নির্দেশ দাতা হিসেবে আলোচনায় এসেছেন দেশব্যাপী আলোচিত কক্সবাজারের ছৈয়দ মোহাম্মদ আলি ওরফে পাওয়ার আলি বা আলি ভাই এর নামও।
কে এই পাওয়ার আলি?
ক্ষমতাবান কিংবা বলবানদের ছায়াতলে থেকে কত চুনোপুঁটি রাতারাতি রাঘববোয়াল বনে গেছে, বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতায় এর হিসাব মেলানো ভার। তাও মাত্র বছর দশেক আগে। এই এক দশকে তার উত্থান রূপকথা গল্পকেও হার মানিয়েছে। গৃহপরিচারক এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। তার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ আলী ওরফে ‘পাওয়ার আলী’ হিসেবে পরিচিত।
তিনি কক্সবাজার সদরের পিএমখালী ইউনিয়নের গোলারপাড়া গ্রামের দরিদ্র নৌকার মাঝি ইলিয়াস প্রকাশ ওরফে কালু মাঝির ছেলে। কক্সবাজারের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর গৃহকর্মী হিসেবে ১৯৯৪ সালে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেছিলেন।
প্রতারক আলীর ক্ষমতার প্রভাব এতই বেশি, কক্সবাজার প্রশাসনের শীর্ষ কর্তা থেকে শুরু করে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারাও আর্শীবাদ পেতে নিয়মিত হাজিরা দেন তার দরবারে। জটিল কোনো সমস্যায় আটকে গেলে জেলার শীর্ষ আমলা ও রাজনীতিবিদরা সাহায্যের জন্য আলীর কাছে ছুটে যান। কক্সবাজার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ অফিসারদের সামনে বসিয়ে রেখে ফোনে সচিব ও আইজিপিকে ধমক দিয়ে কথা বলেন এই আলী। সেই দৃশ্য দেখে রীতিমতো হতচকিত হয়ে যান তারা। এসব ঘটনার সত্যতাও পেয়েছেন কক্সবাজারে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
তারা বিভিন্ন সময় দেখেছেন, এসপি অতিযত্ন করে ঘরে রান্না করা খাবার নিয়ে দেখা করতে আসেন আলীর বাসায়। গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্তা বসে থাকেন আলীর অফিসে। আলী তার কাছে আসা লোকজনকে প্রায়শ বলে বেড়ান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত ফোন করে তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন। শেখ রেহানার সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক। এমনকি আলী নিজের ব্যবহৃত মোবাইলে প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো ক্ষুদে বার্তাও (মেসেজ) কক্সবাজারের শত শত মানুষকে দেখিয়েছেন। প্রতারক আলী হিলারি ক্লিনটন-বারাক ওবামা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সম্পর্কের কথাও বলে বেড়ান। এছাড়া বিভিন্ন বাহিনী প্রধান, গোয়েন্দা প্রধান, পুলিশ প্রধানরা তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেন বলেও প্রচার করেন। অসীম ক্ষমতাধর এই পাওয়ার আলী এখনো পুরো কক্সবাজার জেলা ও তার নিজ এলাকা পিএমখালী ইউনিয়নের চিহ্নিত ত্রাস এবং রহস্যজনক তার মিথ্যা দাপট, প্রতারণা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে এলাকাটি এখন ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। তার কথা ছাড়া এখনো পিএমখালীতে পান থেকে চুন খসেনা।
নয়া শতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ