ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘ভুয়া সনদে’ দুই যুগ ধরে উপাধ্যক্ষ পদে চাকরি!

প্রকাশনার সময়: ২৭ মে ২০২২, ১৮:০৯

মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম! প্রায় দুই যুগ ধরে শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতিসহ নানান মিথ্যা তথ্য প্রদান করে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করছেন ‘উপাধ্যক্ষ’ পদে। একই সাথে সরকারি তহবিল থেকে বেতনভাতা বাবদ হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় কোটি টাকা। বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের কেউই টের পাননি। সম্প্রতি এইসব তথ্য প্রকাশ হলেও ব্যবস্থা নেন নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, অভিযোগ স্থানীয়দের।

মাদ্রাসা সূত্র জানায়, ২০০১ সালের ১ জুলাই কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী বহুমুখী বেশারাতুল উলুম ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসায় ‘উপাধ্যক্ষ’ পদে শহিদুল ইসলাম যোগদান করেন। ইতোমধ্যে তার চাকুরির ২২ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।

মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বৈলতলী জাফরাবাদ গ্রামের আহমদ মিয়ার ছেলে।

রাজাখালী মাদরাসায় যোগদানের আগে দুইটি মাদরাসায় ‘সহকারী মৌলভী’ পদে চাকুরি করেছেন মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম। সেখানে তিনি একাধিক ইনডেক্স নাম্বার ব্যবহার করেছেন। একই পদে ভিন্ন ইনডেক্স নাম্বার কিভাবে হয়? প্রশ্ন সবার। তাছাড়া তার নামে ইস্যুকৃত ‘অভিজ্ঞতা সনদে’ অধ্যক্ষের স্বাক্ষরে জালিয়াতির অভিযোগ এসেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিগত ২৪/১০/১৯৯৫ইং জারিকৃত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসাসমূহ) শিক্ষকের বেতন ভাতাদির কর্মচারীদের সরকারি অংশ প্রদান এবং জনবল কাঠামো সম্পর্কিত নীতিমালা অনুযায়ী ফাযিল মাদরাসায় উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে কাম্য অভিজ্ঞতা না থাকা স্বত্ত্বেও মাওলানা শহিদুল ইসলাম প্রতারণা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পেকুয়ার রাজাখালী বহুমুখী বেশারাতুল উলুম মোহাম্মদ ফাজিল মাদ্রাসায় ওই পদে নিয়োগ লাভ করেন।

দেখা গেছে, বিগত ০১/০৭/২০০০ ইং তারিখ উপাধ্যক্ষ পদে যোগদানকৃত মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম ভুয়া একাধিক ইনডেক্স নং এবং মিথ্যা অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে নিয়োগ লাভ করেন। শুরুতে ৪ হাজার ৮০০ টাকার বেতনে সুবিধা ভোগ করেন। পর্যায়ক্রমে সরকারি বিধি ও নির্দেশনার আলোকে সরকার ফাজিল মাদরাসাকে স্নাতক মর্যাদায় উন্নীত করলে তিনি বর্তমানে (৫ম মোডে) বেতন ৪৭ হাজার ৩০০ টাকা ভোগ করছেন। এই হিসেবে মাওলানা শহিদুল ইসলাম গত ২২ বছরে প্রায় এক কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন, যা আত্নসাতের পর্যায়ে পড়ে।

মুহাম্মদ শহিদুল ইসলামের ৩টি অভিজ্ঞতা সনদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, একটির তথ্যের সাথে আরেকটির মিল নাই।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলাধীন কাঞ্চনা আনওয়ারুল উলুম ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসায় বিগত ১৫/০৮/১৯৯৮ইং হতে ৩০/০১/১৯৯৯ ইং পর্যন্ত ‘সহকারী মাওলানা’ পদে কর্মরত ছিলেন মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম। যার ইনডেক্স নং- ৩১২৩৯৩। একই মাদরাসার অধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত অপর অভিজ্ঞতা সনদে দেখা যায়, মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বিগত ০১/০৬/১৯৯৫ ইং হতে বিগত ৩১/০১/১৯৯৯ইং পর্যন্ত 'সহকারী মৌলভী' দায়িত্ব পালন করেছেন। যার ইনডেক্স নং- ৩১৭৮৮৩। এখানে প্রশ্ন হল, একই মাদরাসায় একই পদে দুই কর্মকাল এবং ভিন্ন ইনডেক্স নাম্বার কিভাবে হয়?

জানা গেছে, মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম সাতকানিয়া রসুলাবাদ ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় ‘প্রধান আরবী প্রভাষক’ পদে যোগদান করেন। ০১/০২/১৯৯৯ ইং হতে ৩০/০৬/২০০১ইং পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

অভিযোগ উঠেছে, প্রভাষকের অভিজ্ঞতা সনদে অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জালিয়াতি করা হয়েছে। এমপিওতেও অধ্যক্ষের স্বাক্ষরে গরমিল রয়েছে। ২০০১ সালের অক্টোবরে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত এমপিওতে প্রধান আরবী প্রভাষক হিসাবে রসুলাবাদ ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা হতে বকেয়াসহ সম্পূর্ণ বেতন উত্তোলন করেন মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম।

অপরদিকে ২০০১ সালের অক্টোবরে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত এমপিওতে একই ইনডেক্স নিয়ে কাম্য অভিজ্ঞতা না থাকার পরও রাজাখালী বি.ইউ.আই ফাজিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে ৪৮ হাজার টাকা বেতন ক্রমে বকেয়াসহ তুলেন মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম।

একজন শিক্ষকের একাধিক অভিজ্ঞতা সনদ ও ইনডেক্স নং থাকার পরেও নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষকে ভূয়া অভিজ্ঞতা সনদ প্রদর্শন করে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ লাভ সম্পূর্ণ বেআইনী ও বিধিবহিভূত। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সরকারি নীতিমালা এবং এমপিও নির্দেশনা অনুযায়ী, তার চাকুরী ও বর্তমানে উপাধ্যক্ষ পদে ৫ম গ্রেডে বেতন উত্তোলন করা ও ভোগ করা সমুদয় টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরৎযোগ্য। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীতিমালার আলোকে অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে স্থানীয়রা।

মাওলানা শহিদুল ইসলাম ফাজিল পাশ করেছেন ১৯৯৫ সালে। তারপর দুই বছর কামিল। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সনদ পাওয়া সাপেক্ষে ‘উপাধ্যক্ষ’ পদে দরখাস্ত করার যোগ্য হবেন। কিন্তু যে বছর ফাজিল পাশ করেছেন সে বছর কেমনে ‘উপাধ্যক্ষ’ হিসেবে নিয়োগ পেলেন? প্রশ্ন সবার।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে মাওলানা শহিদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিক কল করেও পাওয়া যায়নি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও তার কোন জবাব দেন নি তিনি।

এরপর মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকল কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। এমপিও হয়েছে। বেতন তুলছেন। কিভাবে নিয়োগ হয়েছেন তা সংশ্লিষ্টরা তা জানবেন। তবু কারো অভিযোগ থাকলে মাদরাসা বোর্ড; সরকারি তদন্ত সংস্থা আছে, তাদের জানাতে পারেন। তাতে আমার করার কী আছে?

এবিষয়ে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা অফিসার মো. নাসির উদ্দিন বলেন, আপনাদের মাধ্যমে এই খবরটি জানলাম। আসল ঘটনা কি, খোঁজখবর নিয়ে দেখি। অভিযোগ সত্য হলে খুবই দুঃখজনক। ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

নয়া শতাব্দী/এমআরএইচ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ