ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

খেজুর ও চারা বিক্রি করে মোতালেবের আয় কোটি টাকা

প্রকাশনার সময়: ২৭ মে ২০২২, ১৩:৩২

কথায় বলে, ‘টাকা কি গাছে ধরে?’ সাধারণত এ প্রশ্ন তোলা হয়। যার উদ্দেশে তোলা হয়, তাকে বেজার মুখে মুহূর্তেই স্বীকার করে নিতেই হয় যে ‘না, টাকা গাছে ধরে না।’ কিন্তু এখন এর বদলে আরেকটি চটপট জবাব দেওয়া যেতে পারে। বলা যেতে পারে, ‘টাকা না হোক, সোনা ঠিকই গাছে ধরে। না হয় সোনা বেচেই টাকা নেব।’ না, কোনো হেঁয়ালি নয়। সত্যিই গাছে সোনা ধরে। সেটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার আব্দুল মোতালেব।

বাংলাদেশের মাটি যে সোনা ফলা সেটা ভালোই উপলব্ধি করেছিলেন আব্দুল মোতালেব। তাই সাহস করেছিলেন মরুর দেশের খেজুর বীজ এনে দেশে ফলানোর। ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের পাড়াগাঁও গ্রামের এই মানুষটি শুধু সুস্বাদু ও মিষ্টি খেজুরই ফলাননি, মাত্র সাতটি গাছ থেকে হাজার হাজার চারা তৈরি করে ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিদেশের মোহ ছেড়ে দেশে এসে হয়েছেন কোটি টাকার মালিক।

আব্দুল মোতালেব অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে গিয়েছিলেন সৌদি আরব। মাত্র ১০ হাজার টাকা বেতনে খেজুর বাগানে চাকরি নিয়েছিলেন। চাষাবাদ রপ্ত করে তিন বছরের মাথায় দেশে ফেরেন। সঙ্গে আনেন খেজুরের বীজ। বাগান করে কয়েক বছরের মধ্যে বদলে ফেলেন ভাগ্য। এখন বছরে কোটি টাকার চারা ও খেজুর বিক্রি করেন মোতালেব।

আব্দুল মোতালেব (৫৪) ময়মনসিংহের ভালুকার পাড়াগাঁও গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে। তিনি সফল উদ্যোক্তা। সবাই তাকে ‘খেজুর মোতালেব’ বলে ডাকেন।

মোতালেব জানান, দেশে ফিরে বাড়ির পাশে একটি জমিতে খেজুরের চারা রোপন করি। কিন্তু প্রায় সব গাছই পুরুষ হয়ে যাওয়ায় খেজুর হয়নি। পুনরায় গাছ লাগানোর পরও একই অবস্থা। তৃতীয় দফায় সফল হই। সেবার দুটি গাছে খেজুর হয়। সেই দুই গাছ থেকে আজ প্রায় ১২’শ চারা উৎপাদন করেছি।

গত বছর প্রায় ১০০ টি গাছ থেকে ৫ লাখ টাকার খেজুর বিক্রি করেছেন বলে যোগ করেন মোতালেব।

তিনি আরও বলেন, লোকে বিদেশে গেলে স্যুটকেস-ভর্তি জিনিস নিয়ে আসে, আর আমি আনছিলাম খেজুর বীজ। দেশের মানুষ হাসাহাসি করতো, পাগল বলতো। আমার দেওয়া বীজ থেকে ২৭৫টি চারা বের হয়। চারাগুলো সাইজ করে লাগাইনি। তিন বছর তো বেশি সময় না, মুকুল এলে চারা লাগাবো। শুরু করি ২০০১ সালে। ১৭ মাস পর একদিন আমার বউ এসে বললো, ‘তোমার গাছে মুকুল আইছে’। আমি তো বিশ্বাসই করিনি। পরে বাজি ধরে গিয়ে দেখি সত্যিই মুকুল বের হয়েছে, কিন্তু পুরুষ। তখন একটা সাহস এলো পুরুষ মুকুল যখন আসছে তখন মেয়েও হবে। সেটা চৈত্র মাসের ১৭ তারিখ ছিল। বৈশাখে একটা এলো সেটাও পুরুষ। পরের বছর পাঁচটা, তার পরের বছর সাতটা, তার পরেরবার নয়টা গাছে মুকুল এলো, সবগুলো পুরুষ। তবুও হতাশ হইনি। তবে টেনশন বাড়লেও হাল ছাড়ছিলাম না। পরের বছর ১১টা গাছের মধ্যে একটা গাছে মেয়ে মুকুল এলো। তুলে আলাদা করে লাগালাম। এটাই বাংলাদেশে প্রথম সৌদি খেজুর গাছ।

‘এখন আমি কাটিং জানি। নারী গাছগুলো থেকে গজানো চারা নারীই হয়। সেগুলো পুরুষ গাছে কাটিং করে বসানো যায়। এটা সারা বাংলাদেশে আমার মতো কেউ পারে না। আমার সব গাছ কাটিং করে মেয়ে বানাইছি।’

চারা বিক্রির টাকায় তিনি বাগানের উন্নয়নসহ সংসারের নানা চাহিদা পূরণে সমর্থ হন। তিনি জানান, ছোট আকৃতির প্রতিটি চারা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ফলধারক একটি গাছ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকেন। তার বাগানে বর্তমানে ১২০০ ছোট-বড় গাছ রয়েছে। প্রতিটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে ১২ থেকে ১৩ টি কাঁধি হয়। প্রতিটি কাঁধিতে ১০ থেকে ১২ কেজি খেজুর পাওয়া যায়। আজুয়া জাতের খেজুর প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা, আমবাগ প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা, সুকারী ১ হাজার ৫শ টাকা, বরকি ১ হাজার ৫শ টাকা কেজি বিক্রি হয়।

তিনি এক সময় স্ত্রী সন্তান নিয়ে মাটির ঘরে বসবাস করতেন। খেজুর বাগান হতে আয়কৃত টাকায় তিনি দ্বিতল ভবনের বাড়ি করেছেন, ৬ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন যার মূল্য বর্তমানে কোটি টাকার উপরে। তার সাফল্যের জন্য স্ত্রী মজিদা আক্তার সমান অংশীদার।

আজওয়া, ছুক্কারী, আমবাগ, বারহী এবং বকরী জাতের সৌদি খেজুরের মতোই মোতালেবের বাগানের খেজুরের আকার ও স্বাদ। বাজারে এর চাহিদাও বেশ। মোতালেবের বাগানের প্রতি কেজি খেজুর বিক্রি হয় ১ থেকে ২ হাজার টাকা। বড় গাছ অর্থাৎ ১৫-২০ বছর বয়সী সব গাছের জন্য চারপাশ দিয়ে মই আকারে বানিয়েছেন লোহার খাঁচা। খেজুর পাড়া, গাছের পরিচর্যা করতে এতে সুবিধা হয়। বানাতে খরচও হয়ে ২০-৩০ হাজার টাকা করে। আর পরিচর্যাও করা লাগে নিয়মিত। পরিষ্কার করা লাগে নিয়মিত। এছাড়া এখন তার কোনো খরচ নেই।

তার বাগানে কর্মচারী রয়েছে ১৫ জন। সারা বছর কাজ করেন কর্মচারীরা। একেকজনের মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া দেন তিনি। বাগান করতে গিয়ে ছয় বিঘা জমি বিক্রি করছিলেন। আবার কিনেছেন। এখন বছরে ৫০ লাখের মতো আয় হয় তার। আবার খরচও আছে। বাড়তি হিসেবে খেজুরের পাশাপাশি আদা ও কচু লাগান। এ থেকে বছরে আসে ১০-১২ লাখ টাকা।

তিনি বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে গাছ বিক্রি না করে হাজার হাজার চারা বানাতাম। আরও কম দামে চারা বিক্রি করতাম। আগে দেড় লাখ টাকা বেচতাম। কয়েকশ লোক আমার কাছ থেকে চারা নিয়ে বাগান করছেন। আমাদের দেশে খেজুর শুকানো কঠিন। মেঘ-বৃষ্টি বেশি। তাই কাঁচাই বিক্রি করি। খেজুর পেড়ে পাকা অবস্থায় ৬-৭ দিন লাগে শুকাতে।

উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল হবিরবাড়ী ইউনিয়নের পাড়াগাও গ্রামে আব্দুল মোতালেবের বাড়িতে প্রতদিনই দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক। সাধারণ একটি গ্রামে সৌদি খেজুরের বাগান দেখতে সব বয়সীদের আনাগোনা বেশ উপভোগও করছেন মোতালেব আর তার পরিবার।

নয়াশতাব্দী/জেডআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ