ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হোটেল-মোটেল জোনের ত্রাস ডিবি মনিয়ার ‘বিজয় গ্রুপ’

প্রকাশনার সময়: ২৬ মে ২০২২, ১৫:৪৯

ইভটিজিং, মারধর, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে ডিবি মনিয়া। তার উৎপাত আর অপরাধ কর্মকাণ্ড দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোনের এমনই এক ত্রাস ডিবি মনিয়া গ্রুপ ওরফে বিজয় গ্রুপ। এই বাহিনীর সদস্যরা দলবেঁধে দাপিয়ে বেড়ায় কক্সবাজার শহরের প্রতিটি এলাকা।

বহু মামলার আসামি মনিয়া বাহিনীর প্রধান মনিয়া। হত্যা, অপহরণ, মানব পাচার, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ডাকাতি ও মাদকসহ একাধিক মামলার আসামি শাহাদত হোসেন মনিয়া রাজত্ব করছে হোটেল মোটেল জোনে। তার কলাতলীতে ৩৬ জনের একটি ‘বিজয় গ্রুপ’ নামে বাহিনীও রয়েছে। যে বাহিনীতে রয়েছে একাধিক মামলার অনেক সক্রিয় আসামি। সাগরতীরের ত্রাস হিসেবে পরিচিত এই মনিয়া অস্ত্র ও ইয়াবাসহ বহুবার গ্রেপ্তারও হয়েছিল। কিন্তু সহজে জামিনে বের হয়ে তার অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মনিয়া পর্যটকদের কাছেও আতঙ্ক। কক্সবাজার পৌরসভার ১১নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ বাহারছড়া এলাকার আবু শামার ছেলে এই মনিয়াকে অনেকেই ‘ডিবি মনিয়া’ হিসেবেও চেনেন।

তাদের অত্যাচারের অতিষ্ঠ এলাকার সাধারণ মানুষ। এদের নির্যাতনের শিকার হলেও ভয়ে অনেকে প্রতিবাদ করতে সাহস করেন না। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায় তাদের অপকর্ম চলমান আছে।

ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে মূলত নিম্নবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানদের নিয়ে গড়ে উঠেছে ডিবি মনিয়ার বিজয় গ্রুপ। এই গ্রুপে রয়েছে প্রভাবশালীদের বখে যাওয়া কিশোর সন্তানও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপরাধের অংশ হিসেবে গত ১৪ মে বিকালে কলাতলী বীচ ভিউ হোটেলের সামনে থেকে ফারুক নামে এক টমটম চালককে অপহরণ করে মনিয়া বাহিনী। অপহরণ করে পাশের ৫১ একরের পাহাড় নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণের দাবীতে বেড়দক মারধরও করা হয় ফারুককে। বিষয়টি পরিবারের লোকজন জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ ফোন করলে কক্সবাজার সদর থানার একদল পুলিশ গিয়ে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে টমটম চালককে। এই ঘটনায় সদর থানায় লিখিত অভিযোগও দায়ের করে ভিকটিমের স্ত্রী।

দেড় বছর আগে কলাতলী সি ব্লকের ৪৭ নম্বর প্লটের ঝুপড়ি ঘরে থাকা আব্দুল মালেক নামে একজনকে জমি দখলের জন্য অমানবিক নির্যাতন চালায় মনিয়া। পুলিশ খবর পেয়ে মনিয়ার টর্চার সেল থেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় মালেককে উদ্ধার করে।

সে সময় পুলিশ জানিয়েছিল, কলাতলী গণপূর্তের ৬০ নম্বর প্লটটি জবর দখল করে নেন সন্ত্রাসী বাহিনী মুনিয়ার নেতৃত্বে তার দলবল। সেখানেই সন্ত্রাসী মুনিয়া তার বাহিনী নিয়ে অফিস স্থাপন করে। অফিসের নামে সেই টর্চার সেলেই লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায় মুনিয়া। দখল করা সেই জমিতে এখনো মনিয়ার সেই টর্চার সেলে বাহিনীর লোকজনের আনাগোনা রয়েছে।

কয়েক বছর আগে কলাতলীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মিঠুনকে ছুরিকাঘাত করে মনিয়া। ইয়াবা বিক্রির বিষয়ে কয়েক বছর আগে কটেজ জোনে এক পর্যটককে হত্যা করেছিল মনিয়া ও তার বাহিনীর লোকজন। কলাতলীতে গাঁজা বিক্রির ভাগ না পেয়ে মোনাফ নামে একব্যক্তিকেও মারধর করেছিল মনিয়া। চন্দ্রিমা এলাকায় বিশাল জমি দখল করে বিক্রি করে দেন তিনি। কলাতলী টিএন্ডটি এলাকায় সরকারি জমি দখল করে মতি নামে একজনকে বিক্রি করেন মনিয়া। এখন মতির কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদাও নেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিতে তার রয়েছে ৩৬ জনের একটি সিন্ডিকেট। কয়েকজন রিকশা ও টমটম চালকদের সাথে নিয়ে ‘বিজয় গ্রুপ’ নামে একটি নাম সর্বস্ত সমিতি গঠন করে পর্যটন এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মনিয়া। রিকশা ও টমটম চালকের আড়ালে হোটেল মোটেল জোন ও সমুদ্রসৈকত কেন্দ্রিক আগত পর্যটকদের টার্গেট করে তারা। এসব চালকদের টার্গেট গাড়ি থেকে কোন পর্যটক নেমে কোন দিকে যায়। সুযোগ বুঝে পর্যটকদের ভালো হোটেলে কম দামে রুমের কথা বলে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে যায়। এমন ঘটনা ঘটেছে অনেক।

তার বাহিনীতে রিকশা চালকের ছন্দবেশে ‘বিজয় গ্রুপ’ এ রয়েছে, ইয়াবা মামলার আসামি হানিফ, মারামারি মামলার আসামি রাজু, হত্যা ও ছিনতাই মামলার আসামি সিরাজ, ছিনতাই মামলার আসামি কলিম, জমি দখলসহ একাধিক মামলার আসামি মোতাহের, নারী নির্যাতন মামলার আসামি বর্মায়া কামাল ও ঢাকা থেকে পলাতক আসামি মামুন। পর্যটক এলাকায় রিকশা চালকের ছন্দবেশে তারা নিয়মিত মাদক ও নারী পাচারে জড়িত রয়েছে একটি সূত্রে জানা গেছে। এই ‘বিজয় গ্রুপ’ নিয়ন্ত্রণ করেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মনিয়া। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রুপের সকল সদস্য হাজির হন কলাতলীর মনিয়ার জমি দখল করা অফিসে। যেটা টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত। সেখানে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন হিসেব ও পরিকল্পনা নেন মনিয়া।

রিকশা চালকের আড়ালে হোটেল মোটেল জোনে নিয়মিত মাদক সরবরাহ দিচ্ছে কলিম, হানিফ ও মামুন। এসব মাদক জোগান দেন মনিয়া নিজেই। নিজের টর্চার সেলের একটি রুমে নিয়মিত বসে মাদক ও জুয়ার আড্ডা। বসে ইয়াবা সেবনের আসরও। মাদক ছাড়াও নারী পাচারের অংশ নেন হানিফ ও কলিম। তারা হোটেল মোটেল জোনে মাদক ও নারী পাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত।

রিকশা ও টমটম চালকের ছন্দবেশ ছাড়াও তার রয়েছে কয়েকটি সক্রিয় সদস্য। যারা ছিনতাই ও অপহরণ কাজে মনিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত। এরমধ্যে রয়েছে-পতিতা ব্যবসায়ী জাফর, মোরশেদ, মতিন, সিরাজ, রহিম উল্লাহ, জমির, আরাফাত, ফয়সাল ও আয়ুব।

একটি সূত্রে জানা গেছে- কয়েকদিন ধরে মনিয়ার সাথে তার বাহিনীর কয়েকজনের বিরোধও চলছে মাদকের বিষয় নিয়ে। এমনকি তার বাহিনী থেকে জমির, আরাফাত, ফয়সাল ও আয়ুব বের হয়ে যান। মনিয়া বাহিনীর এক সদস্য বলেন- এই কলাতলীতে মনিয়ার উত্থান ১০ বছর আগে থেকে। এমন কোন অপরাধ নেই কলাতলীতে মনিয়া করে না। তার অপরাধের গণ্ডি শুধুমাত্র কলাতলীর হোটেল মোটেল জোন, কটেজ জোন ও সৈকত এলাকা এলাকায়। গত ১০ বছরে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা বেশি ঘটিয়েছে। তবে এসবের তেমন প্রমাণ বা ভিকটিম নেই। অনেক সময় প্রশাসনের লোক ডিবি পরিচয় দিয়েও কটেজ এবং হোটেল থেকে অনেকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছিল। যার কারণে হোটেল মোটেল জোনে সন্ত্রাসী মনিয়াকে অনেকেই ‘ডিবি মনিয়া’ হিসেবে চিনেন।

এদিকে সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৯ জুন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মনিয়া বাহিনীর প্রধান শাহাদত হোসেন মনিয়াকে গ্রেপ্তার করেছিল ডিবি পুলিশ। এ সময় তার কাছে পাওয়া যায় ৩ হাজার ইয়াবা, একটি দেশীয় অস্ত্র ও ২ রাউন্ড কার্তুজ। এসব উদ্ধারের ঘটনায় দীর্ঘদিন জেল কাটেন মনিয়া। এসব মামলায় বেশি দিন জেলে থাকতে হয়নি তার। টাকার জোরে জেল থেকে বের হয়ে ফের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালায় সে। এরপর আরেকটি মামলায় কারাগারে যান তিনি। সর্বশেষ দেড় মাস আগে কারাগার থেকে বের হন তিনি। ফের কারাগার থেকে বের হয়ে জন্ম দেন বহু অপকর্মের।

এইসব বিষয়ে জানতে ডিবি মনিয়ার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার গ্রুপের এক সদস্য জানান, অভিযুক্ত মনিয়া দিনে ঘুমান রাতে সারা শহর দাড়িয়ে বেড়ান।

এবিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, যেসব দাগি আসামি জেল থেকে বের হয় তাদের সবসময় নজরদারীতে রাখা হয়। মনিয়াকেও নজরদারীতে রাখা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তাকে কয়েকবার গ্রেপ্তারও করেছিল পুলিশ। যদি সে আবারো অপরাধে জড়িত থাকে এবং পর্যটক হয়রানি বিষয়ে কোন অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ