পুষ্টিগুনে ভরপুর করলা সবজি হিসেবেও ভাল। বহু ঔষুধি গুন রয়েছে করলায়। মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এই সবজির চাহিদা রয়েছে বজারে। সারা বছরই চাষ করা যায়। রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের জমিতে জন্মেও ভাল। ফলে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়িতে এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে করলা চাষ। কৃষকরা করলা চাষ করে সমৃদ্ধ হচ্ছেন। বাজারে ভাল দাম পাওয়ায় এই অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে করলা চাষে আগ্রহ বাড়ছে।
রাজশাহী গোদাগাড়ি উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, এবার গোদাগাড়িতে ৪০ হেক্টর জমিতে করলা চাষ হয়েছে। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় করলা ভাল জন্মে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে পরাগায়ন বিঘ্নিত হতে পারে। সব রকম মাটিতেই করলার চাষ করা যেতে পারে। জৈব সার সমৃদ্ধ দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ মাটিতে করলা ভাল জন্মে বলে জানায় কৃষি অফিস।
গোদাগাড়ী উপজেলা কাঁকনহাট ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার আশরাফুল আলম বলেন, করলা বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে। এর মধ্যে বারি করলা-১ ও গজ করলা অন্যতম। এসব করলার মোট জীবনকাল প্রায় চার থেকে সারে চার মাস। তবে জাত ও আবহাওয়াভেদে কোন কোন সময় কম বেশী হতে পারে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে যে কোন সময় করলার বীজ বোনা যেতে পারে। কেউ কেউ জানুয়ারি মাসেও বীজ বুনে থাকেন। কিন্তু এ সময় তাপমাত্রা কম থাকায় গাছ দ্রুত বাড়তে পারে না। ফলে আগাম ফসল উৎপাদনে তেমন সুবিধা হয় না। করলার ভাল উৎপাদনের জন্য হেক্টর প্রতি যথাক্রমে ৬ থেকে সাড়ে ৭ কেজি ও ৩ থেকে সাড়ে ৩ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
চারা গজানোর ৪৫-৪৫ দিন পর উচ্ছের গাছ ফল দিতে থাকে। করলা গাছ বেড়ে উঠতে প্রায় ১-২ মাস সময় লেগে যায়। স্ত্রীফুলের পরাগায়নের ১৫-২০ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুমাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ফলন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে উচ্ছে ও করলার হেক্টর প্রতি ফলন যথাক্রমে ৭-১০ টন, যা শতাংশে ৩০-৪০ কেজি) এবং উচ্ছে ২০-২৫ টন যা শতাংশে (৮০-১০০ কেজি) পাওয়া যায়।
করলা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সবজি। স্বাদে তিক্ত হলেও বাংলাদেশের সকলের নিকট এটি প্রিয় সবজি হিসেবে পরিচিত। ১০০ গ্রাম খাবার যোগ্য করলায় ১.৫-২.০ ভাগ আমিষ, ২০-২৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১.৮-২.০ মিলিগ্রাম লৌহ এবং ৮৮.৯৬ মিলিগ্রাম খাদ্যপ্রাণ সি রয়েছে।
করলার উপকারিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, করলা (করল্লা, উচ্ছা, উচ্ছে) এক প্রকার ফল জাতীয় সবজি। এলার্জি প্রতিরোধে এর রস দারুণ উপকারি। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও এটি উত্তম। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে করলার রস খেলে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। করলায় যথেষ্ট পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন ছাড়াও এতে রয়েছে বহু পুষ্টি গুণ।
কৃষিবিদ আশরাফুল আলম বলেন, করলায় ব্রকলি থেকেও দ্বিগুণ বিটা ক্যরোটিন রয়েছে বলে জানান। এতে দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখতে ও চোখের সমস্যা সমাধানে বিটা ক্যারোটিন উপকারি। করলায় প্রচুর পরিমানে আয়রণ রয়েছে। আয়রণ হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে সাহায্য করে। পালংশাকের দ্বিগুণ ক্যালসিয়াম ও কলার দ্বিগুণ পরিমান পটাশিয়াম করলায় রয়েছে। দাঁত ও হাড় ভাল রাখার জন্য ক্যালসিয়াম জরুরি। ব্লাড প্রেশার মেনটেন করার জন্য ও হার্ট ভাল রাখার জন্য পটাশিয়াম প্রয়োজন।
এছাড়াও করলায় যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন-সি রয়েছে। ভিটামিন সি ত্বক ও চুলের জন্য একান্ত জরুরি। ভিটামিন সি আমাদের দেহে প্রোটিন ও আয়রন যোগায় এবং ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ক্ষমতা গড়ে তোলে। ফাইবার সমৃদ্ধ করলা কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা কমায়। করলায় রয়েছে ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, ম্যাগনেসিয়াম, ফলিক এসিড, জিঙ্ক, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম।
চিকিৎসকদের তথ্যমতে, করলা অসুখ নিরাময়ে সাহায্য করে। ডায়বেটিসের রোগির জন্য করলা অত্যন্ত উপকারি। করলায় রয়েছে পলিপেপটাইড পি, যা ব্লাড ও ইউরিন সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে করলার রস ও করলা সিদ্ধ খাওয়া যেতে পারে। নানা রকমের ব্লাড ডিজঅর্ডার যেমন স্ক্যাবিজ, রিং ওয়র্ম এর সমস্যায় করলা উপকারি। ব্লাড পিউরিফিকেশনে সাহায্য করে। স্কিন ডিজিজ ও ইনফেকশন প্রতিরোধে সাহায্য করে।
করলা পাতার রস খুবই উপকারি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, নানা ধরনের ইনফেকশন থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এনার্জি ও স্টেমিনা বাড়িয়ে তুলতেও করলা পাতার রস সাহায্য করে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল খাওয়ার অভ্যাস থেকে লিভার ড্যামেজড হলে, সে সমস্যায় করলা পাতার রস দারুণ কাজে দেয়। ব্লাড ডিজঅর্ডার সমস্যায় লেবুর রস ও করলা পাতার রস মিশিয়ে খেলে অত্যন্ত উপকার হয়। করলা পাতার রসে মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ফেরেনজাইটিসের মতো সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে সোরিয়াসিসের সমস্যা, ফাংগাল ইনফেকশন প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
করলায় নানা ধরনের রোগ বালাই হয়ে থাকে- যেমন করলার কাঁঠালে পোকা, করলার লিফ কার্ল রোগ, ভাইরাস জনিত মোজাইক রোগ, জাব পোকা ও মাছি পোকা। এ সব পোকার আক্রমণ হলে স্থানীয় কৃষি অফিসারের সাথে পরামর্শক্রমে কিটনাশক কিংবা ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
গোদাগাড়ীর মান্ডইল গ্রামের করলা চাষী মঞ্জুর রহমান বাবু বলেন, তিনি মান্ডইল রামদাসপাড়া মাঠে ৬ কাঠা জমিতে করলার চাষ করেছেন। চারা রোপনের পর ৪০ দিনের মধ্যে তিনি তার জমি থেকে করলা উত্তোলন শুরু করেছেন। তার এই ৬কাঠা জমিতে এ পর্যন্ত পনের হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথম চালানে তের হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। এর পরে সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন তিনি করলা উত্তোলন করেন। সপ্তাহে তিনি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বিক্রি করছেন। এভাবে ৫ থেকে ৬মাস পর্যন্ত করলা উত্তোলন করা যায়। এভাবে চলতে থাকলে তিনি ভাল লাভবান হবেন বলে জানান।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ