বাগেরহাটের “সুখী মানুষ” এনজিও’র দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে নয়া শতাব্দী’র বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি রিফাত আল মাহামুদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ২য় পর্ব।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় বাস্তবায়নাধীন “চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি” (পিইডিপি-৪) এর সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫ “আউট-অব-স্কুল চিলড্রেন কর্মসূচি” উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে সারা দেশে চলমান রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাগেরহাট জেলার আটটি উপজেলার ঝড়ে পড়া শিশুদের জন্য চালু করা হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। “সুখী মানুষ” নামক বেসরকারী সংস্থা বাগেরহাট জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য লিড এনজিও হিসেবে নির্বাচিত হয়। “সুখী মানুষ” লিড এনজিও এর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানা ধরনের অনিয়মের মধ্য দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তাদের এই নানাবিধ অনিয়মে প্রকল্পটি এখন ভেস্তের পথে। এমন কি ৩৬ কোটি টাকার এই কর্মসূচি বাস্তবতার নিরীখে বাগেরহাট জেলায় “আউট-অব-স্কুল চিলড্রেন কর্মসূচি” বাস্তবায়ন নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান, সংশয় ও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, “সুখী মানুষ” জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রকল্পের বরাদ্দ ৩৬ কোটি টাকার কোন কাজ না করেই আত্মসাতের পায়তারা করছে বলে একাধিক সূত্রে অভিযোগ রয়েছে। যারাই তার এ ষড়যন্ত্রে সহযোগিতা করে না, তাকেই বাতিল ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা ভাবে হয়রানি করে। “সুখী মানুষ” এর অবৈধ কর্মকান্ডে সহযোগিতা না করায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালককে নানা ভাবে হয়রানী ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি তাকে বদলী করে একজন অনুগত ও বিতর্কিত সহকারী পরিচালককে বাগেরহাটে পোস্টিং করার জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে প্রস্তাব প্রেরণ ও মন্ত্রণালয়ে তদবীর করছে বলে জানা গেছে। এদিকে একাধিক সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের ৩৬ কোটি টাকার কাজ “সুখী মানুষ” প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বাগিয়ে নিয়েছে। টেন্ডার ডকুমেন্ট ও চুক্তিপত্রে “সুখী মানুষ” মার্কেন্টাইল ব্যাংকের যে হিসাব নম্বরের তথ্য দিয়েছে বাস্তবে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে উক্ত নম্বরে “সুখী মানুষ” শিরোনামে কোন হিসাব নম্বর নেই। যদিও ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট টেন্ডার ডকুমেন্টের একটি আবশ্যিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে প্রতারণা প্রমাণিত হলে টেন্ডার এমনকি প্রাপ্ত কার্যাদেশ বাতিলের বিধান রয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো “সুখী মানুষ” এর ব্যাংক হিসাব জালিয়াতির বিষয়ে তথ্য পেয়েও রহস্যজনক কারণে “সুখী মানুষ” এর বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
এছাড়াও “সুখী মানুষ” এর বিরুদ্ধে এসোসিয়েট এনজিও নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসোসিয়েট এনজিও হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে “সুখী মানুষ” অনেক এনজিও’র কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ বিষয়ে ছায়া কুঞ্জ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি ও শাপলাফুল সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামক দুটি এনজিও লিড এনজিও “সুখী মানুষ” এর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। লিড এনজিও “সুখী মানুষ” রামপাল ও মোংলা উপজেলায় সিডোপ, কচুয়া উপজেলায় নিকেতন সেবা সংস্থা এবং মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় প্রতিভা সংস্থার সাথে এসোসিয়েট এনজিও হিসেবে কাজ করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। হঠাৎ করেই কর্মসূচি চলমান থাকতেই মিথ্যা অজুহাতে চুক্তির শর্ত সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে এসোসিয়েট এনজিও’র চুক্তি বাতিল করে এবং মোটা অংকের লেনদেনের বিনিময়ে উক্ত উপজেলাগুলোতে নতুন করে এসোসিয়েট এনজিও নিয়োগ করে। এসোসিয়েট এনজিও’র সাথে চুক্তি বাতিলের পূর্বে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অনুমোদন নেয়ার বিধান থাকলেও এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা অবৈধ লেনদেনের অংশের বিনিময়ে “সুখী মানুষ” এর সব অনিয়ম দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে দাবি করছেন এসোসিয়েট এনজিও’র প্রতিনিধিরা।
প্রকল্পের পার্টনার এনজিও (প্রতিভা সংস্থার) পরিচালক গোবিন্দ দাস বলেন, শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) এর সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫ অনুসরণে আউট-অব-স্কুল চিলড্রেন কর্মসূচিতে লীড এনজিও “সুখি মানুষ” এনজিওর মাধ্যমে আমরা পার্টনার এনজিও হিসেবে কাজ পাই। ২০২১ থেকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় কাজ করে আসছি। চুক্তি করার সময় সুখি মানুষ আমাদের সাথে গড়িমসি করতে থাকে। অধিদপ্তর থেকে তাদের চিঠি দিয়ে দ্রুত চুক্তি করবার চাপ প্রয়োগ করে। তারা চুক্তি করলে আমরা মাঠ পর্যায়ে জরিপের কাজ শুরু করি। কিন্তু সুখী মানুষ এনজিও নির্বাহী পরিচালক নাফিজা আফরোজ মুঠোফোনের মাধ্যমে আমাদের কাজ বন্ধ করতে বলেন। পরে প্রকল্প পরিচালক সোহেল আহমেদের হস্তক্ষেপে কাজ পুনরায় শুরু করি ও জরিপ কাজ সম্পন্ন করি। পরবর্তীতে আমাদের কাগজপত্র নেই মর্মে চিঠি দেওয়া হয় ও বিভিন্ন চাপ প্রয়োগ করে। এক পর্যায়ে টাকা দাবি করলে আমরা দিতে অস্বীকৃতি জানাই। পরে তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আমাদের প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার পায়তারা করে।
তিনি বলেন বাগেরহাটের সহকারী পরিচালক অগ্রজ কুমার রায় আমার সকল কাগজপত্র দেখেছে ও তা সঠিক আছে এ মর্মে চিঠি ও দিয়েছে। আমরা ঢাকায় ডিজি মহোদয়ের কাছে আমাদের কাগজপত্র ও জমা দেই।
সদর উপজেলার একাধিক জরিপকারী বলেন, প্রথম থেকে জরিপের কার্যক্রম পরিচালনা থেকে শুরু করে ফটোকপি, যাতায়াত, ভাতার জন্য কোন টাকাই পাই নাই। আজ না কাল বলে কালক্ষেপণ করছে। কবে টাকা ফেরত পাব তা জানি না। লীড এনজিও “সুখী মানুষ” ৮টি উপজেলায় উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার পদে লোক নিয়োগ করে। তাদের প্রত্যেকের নিকট থেকে জামানতের নামে অর্থ গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ করেছে। তাদের কাউকে কোন বেতন প্রদান করেনি। এছাড়া এসকল কর্মকর্তাদের দিয়ে নানাবিধ, দুর্নীতি, জালিয়াতি, প্রতারণা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে অর্থ আত্মসাতের পরিকল্পনা করে। রাজি না হলে তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ হুমকি-ধামকী ও হয়রানীমুলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতো। এসব বিষয়ে ৮ জন উপজেলা কর্মকর্তা ও জেলা ম্যানেজার (ডিপিএম) বিভিন্ন সময় সহকারী পরিচালক, বাগেরহাট এর নিকট একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করেছেন।
বাগেরহাট সদর উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ইউপিএম) প্রতিমা চক্রবর্তী বলেন, ‘সুখী মানুষ’ এনজিওতে ৫০ হাজার টাকা জামানত দিয়ে নভেম্বর/২০২০ মাস থেকে কার্যক্রম শুরু করি। চাকুরির শুরুতে ল্যাপটপ সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা কোন প্রতিশ্রুতি রাখেনি। আমাদের নিজেদের খরচ দিয়ে ফটোকপি, ডাটা এন্ট্রি, যাতায়ত সহ প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। জুন,২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানের বাজেট আসলে আমাদের বেতন বিলে স্বাক্ষর জাল করে টাকা উত্তোলন করে তারা। আমি টাকা চাইলে কোন টাকা পরিশোধ না করে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। তবে বাগেরহাট জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো থেকে আমাকে এখন ও পযর্ন্ত বরখাস্ত করেন নাই আমি অফিসিয়ালি এখনও উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার আছি।
এবিষয়ে “সুখী মানুষ” এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক নাফিজা আফরোজ বর্নোর সাথে একাধিকবার ০১৭১২**৫৭৮৮ এই নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেন নাই।
বাগেরহাট জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক শুভ বণিক এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখানে ১৫ই মার্চ-২০২২ তারিখে যোগদান করেছি এবং যোগদানের পরেই বাগেরহাট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত লিড এনজিও’র সাথে মিটিং করি। তাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়েছি। লিড এনজিও “সুখী মানুষ” প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়ার কথা বলেও অদ্যবধি আমাকে দেয়নি। জনবল ও শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পূর্বে যেসকল উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদেরকে সহকারী পরিচালক অনুমোদন দিয়েছেন। বর্তমানে নতুন করে “সুখী মানুষ” যে সকল জনবল নিয়োগ দিয়েছে তাতে সহকারী পরিচালকের অনুমোদন নেইনি। বর্তমানে লিড এনজিও “সুখী মানুষ” এর সাথে যারা কাজ করছে তাদের সবাইকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যা নিয়ম বহির্ভূত। বাস্তবতার নিরীখে বাগেরহাট জেলায় “আউট-অব-স্কুল চিলড্রেন কর্মসূচি” বাস্তবায়ন নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান, সংশয় ও উদ্বেগের মধ্যে আছি।
তিনি আরো জানান, শিক্ষক নিয়োগ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার আর সদস্য সচিব উপজেলা ম্যানেজার এখানে নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিবই অবৈধ সেখানে সকল নিয়োগই অবৈধ নিয়ম বহির্ভূত । তারা কোন আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছা খুশি মত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এভাবে আইন বহির্ভূত ভাবে কোন প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।
নয়া শতাব্দী/এমআরএইচ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ