দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন সচ্ছল পরিবারের লোকজন। কক্সবাজারের উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নে এ ঘটনাই ঘটেছে।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি আইন অনুযায়ী বসতবাড়ি এবং জমি নেই এমন ভূমিহীন পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে। এলাকায় সে রকম পরিবার না পাওয়া গেলে ১০ শতকের কম জমি আছে এমন পরিবারকে ঘর বরাদ্দ দিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে ১৫ জন ঘর বরাদ্দ পেয়েছে সেখানে থাকছেন না, তারা আসলে গৃহহীনই ছিলেন না। তাদের কয়েকজন বেশ সম্পদশালী। একজন আবার সৌদি প্রবাসী, যার তিনতলা ভবন নির্মাণ চলছে। কারও কারও বাড়ির পাশাপাশি জমিজমা আছে।
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের ২০ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ে উখিয়া উপজেলার ১৪৫টি অসহায় ‘ভূমিহীন ও গৃহহীন’ পরিবারকে জমি ও ঘর উপহার দেয় সরকার। এর মধ্যে ১৮টি ঘর দেয়া হয় উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নে। ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হলুদবনিয়া এলাকায় খাসজমিতে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়।
জানা গেছে, একটি ইউনিয়নে গৃহহীন হিসেবে যে ১৮ জনকে ঘর দেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেবল তিনজন সেই ঘরে থাকছেন। বাকি ঘরগুলো কেউ বিক্রি করে দিয়েছেন, কেউ দিয়েছেন ভাড়া, কেউ উপহার হিসেবে দিয়েছেন স্বজনদের। তারা সবাই ইউনিয়নটির সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলমের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলতেন। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন যাচাই-বাছাই ছাড়াই এদের গৃহহীন হিসেবে ধরে নিয়ে ঘর দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলছেন, তিনি এসব বরাদ্দ বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছেন। উপহারের এসব ঘরের মালিকানা স্থানান্তরযোগ্য না হলেও ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় তা বিক্রির তথ্য মিলেছে।
হলদিয়াপালং ইউনিয়নের যে ১৮টি ঘর করা হয়েছে, তার মধ্যে কেবল তিনটিতে বরাদ্দপ্রাপ্তদের থাকতে দেখা গেছে। মোহাম্মদ আলী, মনোয়ারা বেগম ও এরশাদ উল্লাহ থাকছেন নিজেদের ঘরে। তারা কেউ গৃহহীন নন।
নূর মোহাম্মদ নামে একজনকে বরাদ্দ দেয়া ঘরটি তিনি তার ভাগনী রহিমা বেগমকে বিয়ের উপহার দিয়েছেন বলে দাবি করেন রহিমার স্বামী মো. রাশেদ। নূর মোহাম্মদ গৃহহীন নন। তিনি চাষাবাদ করেন, আবার ব্যবসাও আছে।
শামসুল আলম নামে একজন বরাদ্দ পেয়ে ঘরটি বিক্রি করে দিয়েছেন ৩০ হাজার টাকায়। সেটি কিনেছেন আব্দুল আমিন নামে একজন। তিনি সেই ঘর ভাড়া দিয়েছেন আমিনা বেগম নামে এক নারীর কাছে।
হলদিয়াপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে নিজস্ব ঘরবাড়ি, জমিজমা রয়েছে, সেটি স্বীকারও করেছেন শামসুল। তার পরও উপহারের ঘর নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তিন ভাই এক বসতঘরে থাকি। একটু গাদাগাদি হয়। তার জন্য বাড়িটা নিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের এক বোন থাকেন, আমিনা।
আব্দুল আমিন নামে একজনের কাছে ঘরটি বিক্রি করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি ‘ভুল কথা’ বলে ফোন কেটে দেন। ঘর বরাদ্দ পেয়ে সাহাব মিয়া নামে একজন সেটি ভাড়া দিয়েছেন স্থানীয় ইটভাটার এক কর্মীর কাছে। সাহাব মিয়ারও নিজস্ব ঘরবাড়ি রয়েছে। তার জমিও আছে।
জাহাঙ্গীর আলম নামে আরেক বরাদ্দপ্রাপ্ত ঘরটি মো. শামছু নামে একজনের কাছে বিক্রি করেছেন ৫০ হাজার টাকায়।
একই ইউনিয়নের রুমখা তেলীপাড়ায় নিজস্ব ঘরবাড়ি আছে জাহাঙ্গীরের। তার কাছ থেকে বাড়ি কেনার পর কয়েকবার এলেও পরে আর দেখা যায়নি শামছুকেও। তাকে ভালো করে কেউ চেনেনও না।
ঘর বিক্রি করে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সাবেক চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে আমার দুই গণ্ডা জমি আছে। যেখানে আমি বসবাস করি। আমার ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। এত দূরে কী করে থাকব?’
গৃহহীন না হয়ে কেন ঘর নিলেন- এমন প্রশ্নে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘চেয়ারম্যান বলেছিল আমার জমিতে ঘর দেবে। এত দূরে দেবে জানতাম না।’
শামছুর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সে গরিব, তার ঘরবাড়ি নেই। সে জন্য থাকতে দিছিলাম।’
এই প্রকল্পে হামিদুল হক নামে এক প্রবাসীকেও ঘর দেয়া হয়। তিনি ঘরটি কোনোদিন ব্যবহার করেননি। তিনিও সেটি বিক্রির চেষ্টা করছেন।
হামিদুল সৌদি আরবে থাকেন। তার স্ত্রী লায়লা বেগম ও সন্তানরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হলুদবনিয়া এলাকায় থাকেন। তাদের তিনতলা একটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে।
এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রথম ঘরটি দেয়া হয় মো. ইছাকে। উদ্বোধনের পর থেকেই সেটি আড্ডার জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে। ইছা গাড়িচালক। তিনি বিতর্কিত ধর্মীয় বক্তা আমির হামজার গাড়ি চালান। ইছারও নিজস্ব ঘরবাড়ি আছে ওই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে।
সম্পদ থাকার পরও তাদের নামে গরিবের ঘর বরাদ্দের পেছনে মূল ভূমিকায় ছিলেন হলদিয়াপালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম। তিনি গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হেরে গেছেন।
বিনা মূল্যের ঘর না পাওয়ার কথা থাকলেও যারা পেয়েছেন, তারা সবাই শাহ আলমের সমর্থক।
তবে শাহ আলম এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘বর্তমান চেয়ারম্যানের যোগসাজশে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। ইউএনও এর সঙ্গে জড়িত।’
তবে যাদের ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন তারা তো গৃহহীন নন- এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান সাবেক চেয়ারম্যান।
যে সময় ঘরগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়, সে সময় উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন নিজামউদ্দিন আহমেদ, যিনি উপকারভোগীদের তালিকা চূড়ান্ত করেছেন।
তিনি বর্তমানে নোয়াখালী সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। সম্পদশালীদেরকে গৃহহীনদের ঘর দেয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তালিকার ভিত্তিতেই ঘরবাড়িগুলো গৃহহীনদের দেয়া হয়েছে।’
তাহলে আপনাদের দায়িত্ব কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। একসঙ্গে অনেক ঘর দেয়ার কারণে ভুল হতে পারে।
‘যদি এমন কেউ (সম্পদশালী) থেকে থাকে, তাহলে সরকারের যে বিধিমালা, তাতেই উল্লেখ আছে, ঘরগুলো তাদের কাছ থেকে নিয়ে প্রকৃত গৃহহীনদের কাছে হাস্তান্তর করা হবে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য সরওয়ার কামাল বাদশা বলেন, ‘মুজিববর্ষের ঘর যারা উপহার পেয়েছেন তাদের প্রায় সবার নিজস্ব ঘরবাড়ি রয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের এসব ঘরে তারা থাকেন না।’
নুরুল আলম নামে এক রিকশাচালক জানিয়েছেন, তার ঘরবাড়ি নেই। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ২ নম্বর ওয়ার্ডে একজনের সেচের মোটর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি বলেন, কদিন পর বর্ষা শুরু হলে কোথায় থাকবেন জানেন না। অথচ মুজিববর্ষের ঘরগুলো দেয়া হয়েছে, যাদের ঘরবাড়ি আছে তাদের।
যা বলছে উপজেলা প্রশাসন : উপহারের ঘর বিক্রি, উপহার বা ভাড়া দেয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া কথা জানিয়েছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান হোসেন সজিব। এসব ঘর বরাদ্দ দেয়ার সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না জানিয়ে বলেন, ‘এসব অভিযোগ শোনার পর পরই আমি পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিকভাবে এসব ঘরে তিনটি পরিবারকে পেয়েছি। বাকিদের যেহেতু পাওয়া যায়নি, তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে ওপর মহলে বলা হয়েছে।’
হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ‘১৮টি ঘরের মাত্র তিনটিতে প্রকৃত মালিকরা রয়েছেন। ঘরগুলো প্রদানের সময় অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়েছিল। তাই প্রকৃত ভূমিহীনরা এগুলো পাননি।’
তিনি জানান, যেসব ঘর খালি পড়ে আছে বা ভাড়া দেয়া হয়েছে, তাদের বরাদ্দ বাতিল করতে গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হলদিয়াপালং ইউনিয়ন সভাপতি মোহাম্মদ ইসলামও। তিনি বলেন, ‘মুজিববর্ষের ঘর উপহার দেয়ার সময় প্রকৃত ভূমিহীনদের দেয়া হয়নি। সেই সময়ের হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলম নিজের অনুসারীদের এসব ঘর দিয়েছেন। হলদিয়াপালংয়ের প্রকৃত ভূমিহীনরা এখনও ভূমিহীন রয়ে গেছেন।’
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ