রেস্টুরেন্ট ও খামার ব্যবসায়ীর বেশ ধরে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় কোটি কোটি টাকার চালান পাঠিয়ে ইয়াবা বিক্রিকারী চক্রের রক্ষা মিললো না এবার। অভিনব কায়দায় দীর্ঘদিন ধরে সে মাদক পাচার করে গেলেও গত ২৩ এপ্রিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব ১৫ তাকে আটক করেছে। আটকের পর বেরিয়ে এসেছে তার অভিনব কৌশলের আদ্যেপান্ত।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসতে সে এবং তার সিন্ডিকেট মহাসড়ক ব্যবহার করতো না। তারা গ্রামের রাস্তা ও নদী পথ ব্যবহার করে ৫ থেকে ৭ দিন সময় ব্যয় করে ঢাকায় পৌঁছাতো। সেই চক্রের এক সদস্যকে গত ২৩ এপ্রিল উখিয়া থেকে আটক করেছে র্যাব-১৫। এসময় তার কাছ থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।
আটককৃত ছদ্মবেশী মাদক কারবারীর নাম আব্দুল গফুল (৩৮)। তিনি কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া বাজারপাড়া এলাকার নুর মোহাম্মদের ছেলে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, র্যাব-১৫ এর একটি আভিযানিক দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে একজন মাদক কারবারী মাদকের একটি বড় চালান নিয়ে ঘুমধুম হয়ে উখিয়া দিয়ে লিংকরোড এলাকায় হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। এ খবরের ভিত্তিতে র্যাব-১৫ এর একটি দল গত ২৩ এপ্রিল উখিয়া বালুখালী চেকপোষ্ট এলাকায় অবস্থান নেয়। সেখান থেকে আব্দুল গফুরকে আটক করা হয়। এ সময় তার সাথে থাকা মোটরসাইকেলে বহনযোগ্য ব্যাগের ভেতর বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে আনা ইয়াবার কথা স্বীকার করে। পরে ব্যাগের অংশ কেটে তার ভেতর থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পারস্পরিক যোগসাজসে নিয়মিত কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা ও সমুদ্র পথে বাংলাদেশে আসা ইয়াবা ট্যাবলেট রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে আসছিল। আটককৃত মাদক কারবারী আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে অভিনব কায়দা হিসেবে কখনো হোটেল ব্যবসা, কখনো পোল্ট্রি ফার্মের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারণ করে মাদক বহন করে নিয়ে আসতো। মাদক পরিবহনের জন্য বহনযোগ্য মোটরসাইকেলের মধ্যে বিশেষ কায়দায় ইয়াবা লুকিয়ে তা আবার ঝালাই করে জোড়া লাগিয়ে দিতো। সে মাদক চালানোর ক্ষেত্রে কক্সবাজার এলাকা থেকে রাজধানী পর্যন্ত নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কখোনই মহাসড়ক ব্যবহার করতো না।
আরো জানা যায়, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসার ক্ষেত্রে সে মহাসড়ক ব্যবহার না করে বিকল্প হিসেবে গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে বিভিন্ন ইজি বাইক, সিএনজি অটোরিকশা, ট্রেম্পু ব্যবহার করে পথ পাড়ি দিতো। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার ক্ষেত্রে সে এবং তার সিন্ডিকেট আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে প্রথমে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে হাটহাজারী মানিকছড়ি গুইমারা রামগড় হয়ে ফেনী আসতো। সেখান থেকে সে নোয়াখালীর চৌমুহনী সোনাইমুড়ি এবং চাদপুরের হাজীগঞ্জ হয়ে মতলব লঞ্চঘাট পর্যন্ত আসতো। দ্বিতীয় ধাপে সে সেখান থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় চড়ে মুন্সিগঞ্জ হয়ে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতো। এতে করে তার ৪/৫ দিন লেগে যেতো ঢাকা আসতে। এই দীর্ঘ সময় সে যাযাবরের মতো জীবন যাপন করতো। সাধারণ মানুষের সন্দেহ দূর করতে মাঝ পথে ভ্রমনের উদ্দেশ্যে আসছে এমন কৌশলে চলাফেরা করতো।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘তথ্য থাকলেও কৌশল ও জনবলের দিক দিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না তাঁরা। আর পুলিশ বলছে, মাদকের এই হোতাদের ধরতে তাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে।’
পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, এই মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁদেরই কোনো কোনো কর্মচারী ও সোর্সদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। এরা প্রশাসনের গতিবিধি আগাম জানিয়ে দেয়। কিন্তু এদের চিহ্নিত করতে পারছেন না তাঁরা।
এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, গফুর বাজারপাড়া হলেও তার মুল সিন্ডিকেট নয়াপাড়া এলাকায়। দীর্ঘদিন থেকে তিনি পোল্ট্রিফার্মে গোপনে ইয়াবার ব্যবসা করতেন। পরে ব্যবসার তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে পরিবারসহ বাড়ি ছেড়ে চলে যান বাজারপাড়ায়। নয়াপাড়া এলাকায় তার পৃষ্টপোষক হিসেবে একজন সমাজপতি সবকিছু দেখভাল করে এমনটাই দাবী করেছে স্থানীরা। এখন তিনি এলাকায় এসে সহকারীদের হাতে ইয়াবা তুলে দিয়ে চলে যান। সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর এলাকায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
গত মঙ্গলবার ও বুধবার নয়াপাড়া এলাকায় গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ী আর স্থানীয় ও বহিরাগত ক্রেতাদের উৎপাতে অতিষ্ঠ তাঁরা। তাঁদের প্রশ্ন, ব্যবসায়ীরা চিহ্নিত হওয়ার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না। প্রশাসন সবকিছু জানলেও এলাকায় কীভাবে মাদকের বিস্তার ঘটছে?’
বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগে গোপনে বিক্রি হলেও দুই বছর ধরে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হচ্ছে এলাকার ওয়াসা রিজার্ভারের চারপাশ, মসজিদের সামনে। স্থানীয় ক্রেতার পাশাপাশি এসব জায়গায় মাদক কিনতে আসেন বহিরাগতরাও। এরা রাস্তা ও গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ইভ টিজিংও করে স্কুলগামীদের।
মসজিদের সামনে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাসিন্দা বললেন, ‘মাদকের বিস্তারের কারণে উঠতি বয়সী ছেলেদের নিয়ে বেশি চিন্তায় থাকতে হয়। ব্যবসায়ীদের টার্গেট তো তরুণরাই।’
আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘কারা ব্যবসা করে সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু কিছু বলার নাই। বল্লেই আমরা তাঁদের টার্গেট হয়ে যাব। তখন দেখা যাবে, আমাদের উপর বিপদ আসবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উখিয়া থানার এসআই নুর আলম বলেন, ‘গত ২৩ এপ্রিল র্যাব ১০ হাজার ইয়াবাসহ আব্দুল গফুর নামে এক মাদক কারবারিকে থানায় সোর্পদ করেছে। তার সিন্ডিকেটে আর কে কে আছে সেই তদন্ত চলছে। সম্পৃক্ততা পেলে তাদেরকেও ওই মামলায় আসামী করা হবে। বিস্তারিত পরে জানা যাবে।’
নয়া শতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ