ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপরের নির্দেশে মোরশেদকে হত্যা করা হচ্ছে, কেউ সামনে আসবেনা! 

প্রকাশনার সময়: ০৯ এপ্রিল ২০২২, ০২:১০ | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২২, ০২:৩৬

উপরের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হচ্ছে, কেউ সামনে আসবেনা বলা মাত্রই মারধর শুরু করে এমনটাই দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। গত ৭ এপ্রিল ইফতার কেনার সময় জনসম্মুখে মোরশেদ আলী (৩৮) নামে এক যুবককে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। কক্সবাজার সদরের পিএমখালী ইউনিয়নের চেরাংঘর বাজারে সড়কের উপর জনসম্মুখে এই হত্যাকাণ্ড ঘটনা ঘটে। কোন উপরের নির্দেশ তাকে হত্যা করা হয়েছে সে তথ্য বের করতে মাঠে নেমেছে প্রশাসন।

সারাদিনের রোজায় বেশি ক্লান্ত, ইফতারের সুযোগ দাও, মারতে চাইলে ইফতারের পর মারিও (প্রহার করো)।’ এমন আকুতি জানিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি মোরশেদ আলী ওরফে বলী মোরশেদের (৩৮)।

ময়না তদন্ত শেষে শুক্রবার (৮ এপ্রিল) দুপুরে মোশেদের লাশ পিএমখালীর মাইজপাড়া গ্রামের বাড়িতে আনা হলে স্ত্রী নাসরিন সুলতানা রেখা, মেয়ে স্বপ্নমনি, মরিয়ম, ছেলে সুজনসহ স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে চারপাশ। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।

এদিকে যেখানে মোর্শেদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সেই ঘটনাস্থলে এসে রক্তের দাগ ছুঁয়ে বসে এক বৃদ্ধা বিলাপ করছিলেন। তার নাম হালিমা খাতুন (৬৫)। নিহত মোর্শেদ তার সন্তান। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সারাদিন রোজা রেখে ইফতার করা হলনা আমার ছেলের। ঘাতকরা ইফতার করতে পর্যন্ত সময় না দিয়ে আমার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে। এ কোন নির্মমতা। ইফতার করতে সময় ভিক্ষা চেয়েও ওদের অন্তরে একটুও মায়া হয়নি। এই নিষ্টুর সমাজে বেঁচে থেকে আর লাভ কী! কার জন্য বাঁচিয়ে রাখলে আল্লাহ! যারা আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে, তুমি তাদের বিচার করো।’

চেরাংঘাটা বাজারে সন্তানের রক্তের দাগের পাশে আহাজারি থামছিল না মায়ের। প্রতিবেশী, বাজারে আসা ক্রেতা-বিক্রেতা ও আত্মীয়স্বজনেরা তাকে বারবার শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মা হালিমা খাতুনের কান্না থামছেই না।

শোকাবহ পরিবেশে বিকেলে জানাজা শেষে বাড়ির সামনে মসজিদের দক্ষিণ পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। এ সময় মোর্শেদের জানাজার মাঠে একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন জেলা আ.লীগের নেতাসহ স্বজনরা।

অন্যদিকে এই খুনের ঘটনায় দিদার নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ। আটক দিদার কক্সবাজার শহরের আলোচিত ব্যক্তি সৈয়দ মোহাম্মদ আলী ওরফে পাওয়ার আলীর ভাই। এ সময় আরো ২ জনকে আটক করা হয়। তারা হলেন, জাহেদ, ইয়াছিন আরফাত।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার স্বাক্ষী বাংলাবাজার এলাকার আলী আহমদ কোম্পানি জানান, তিনি বাজার করতে চেরাংঘর বাজারে পৌছার ঠিক একটু পরে শোরগোল শুনতে পান। কিছুটা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি যাওয়ার পর পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল বলে উঠেন 'উপরের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হচ্ছে, কেউ সামনে আসবেনা'। এই কথা শেষ হতে না হতে সদর উপজেলা যুবলীগের নেতা আবদুল মালেক লোহার রড দিয়ে সজোরে আঘাত করে মোরশেদ আলীর মাথায়।

এরপর উৎপেতে থাকা তাদের পরিবারের ও বহিরাগত আরো ১৫-২০জন স্ব-শস্ত্র যুবক ঝাপিয়ে পড়ে মোরশেদ আলীর উপর। সবাইকে নির্দেশ প্রদান করছিলেন পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল। ৫ থেকে ৭ মিনিট পর্যন্ত মোরশেদ আলীকে এলোপাতাড়ি মারধর ও কুপানোর পর সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তারা কয়েক রাউন্ড ফাকা গুলি বর্ষণ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। একই বক্তব্য প্রদান করেন আরো বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।

বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) রাত ৮টার দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। ময়না তদন্ত শেষে ৮ এপ্রিল বিকেল ৫ টার সময় জানাজা ও দাফন কাফন সস্পন্ন করে মোরশেদের পরিবার। সৌদি প্রবাসী মোরশেদ আলী সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের মাইজপাড়ার মৃত মাওলানা মাষ্টার ওমর আলীর ছেলে। তিনি এলাকায় ‘অন্যায়ের প্রতিবাদকারী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এবং শখের বসে দেশে ঘুরতে আসলে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলীখেলায় অংশগ্রহণ করতেন। সে সুবাদে তাকে সবাই মোরশেদ বলী নামে ডাকে।

সরেজমিনে পিএমখালী ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ান এই সিন্ডিকেট। নানা অপরাধে জড়িত পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক জন নেতাকর্মী। পাহাড় কাটা, বন দখল, জমি দখল, বিচারের নামে প্রহসন, চাঁদাবাজি, ইয়াবা সিন্ডিকেট সহ নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। পুরা ইউনিয়ন জুড়ে চলে তাদের রাজত্ব। ভারি অস্ত্র থাকায় ভয়ে মুখ খোলেনা কেউ। প্রতিবাদ করলেই মোরশেদ বলীর মত জীবন দিতে হবে যে কাউকে। ইউনিয়ন জুড়ে কেউ জমি ক্রয় বিক্রয় করলে বা দালান ঘর নির্মাণ করলে তাদের মাসোহারা দিতে হয় এমনটাই নিজস্ব নিয়ম তৈরি করেছে উক্ত সিন্ডিকেট।

মোরশেদ আলী হত্যার সাথে জড়িত আবদুল মালেক, তাহের, মতিউল ইসলাম মতি, সিরাজুল মোস্তফা আলালসহ বেশ কয়েকজন একাধিক মামলার দাগি আসামি। এর মধ্যে আবদুল মালেক ও মতিউল ইসলাম মতি সদ্য জেল ফেরত আসামি বলে জানা গেছে।

পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এমন জঘন্যতম কর্মকাণ্ডের পরেও উক্ত কমিটি ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনো। কেনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে। ক্ষুদ ইউনিয়ন সভাপতি নিজে দাড়িয়ে নির্দেশনা প্রদান করে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। যা সিসিটিভির ফুটেজ, মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য প্রশাসনের হাতে ইতিমধ্যে পৌছেছে।

এবিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, মোরশেদ খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দিদারসহ ৩ জনকে আটক করা হয়েছে। খুনিদের চিহ্নত করে আইনের আওতায় আনতে ইতামধ্যে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে।

নয়া শতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ