ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হারাতে বসেছে পিরোজপুরের রাজবাড়ির শেষ চিহ্ন

প্রকাশনার সময়: ০৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:০৫ | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:২৪

রক্ষণাবেক্ষণর অভাবে হারাতে বসেছে পিরোজপুরের রায়েরকাঠি রাজবাড়ির শেষ চিহ্ন। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজা রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে রায়েরকাঠি গ্রামে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূল রাজবাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও কালের সাক্ষী হয়ে আছে ৩৫৭ বছরের পুরনো কালীমন্দির এবং ৭৫ ফুট উচ্চতার ১১টি মঠ।

স্থানীয়রা জানান, সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে দ্রুত এগুলো ও হারিয়ে যাবে। মোগল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ির পূর্ব দিকে রয়েছে কালী ও শিবমন্দির। কালের বিবর্তনে ধ্বংসের পথে রাজবাড়ির অধিকাংশ ভবন। সংস্কারের অভাবে সুউচ্চ মঠগুলো ভেঙে যাচ্ছে।

পিরোজপুরের ইতিহাস গবেষক গোলাম মোস্তফা তার সংগ্রামী পিরোজপুর বইয়ে লিখেছেন, ‘সম্রাট আকবরের সময় যুবরাজ সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) বিদ্রোহ করে বাংলা মুলুকে আসেন। এরপর তিনি ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগণার সৃষ্টি করেন। নিজের নামে পরগণার নাম রাখেন সেলিমাবাদ। ১৬১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগণার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান মদন মোহন। ১৬২৮ সালে মদন মোহন তার ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগণার পাট্টা নেন। শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাচারি স্থাপন করে সেখানে বসবাস করতেন।

এরপর মোগল সম্রাট ওই শ্রীনাথকে রাজা উপাধি দেন। ১৬৫৮ সালের শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে বসবাস শুরু করেন। সেখানে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বন জঙ্গল কেটে রাজ্য স্থাপন করেন বলেই নামকরণ করা হয়েছে রায়েরকাঠি।

রাজা রুদ্র নারায়ণ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় পাঁচজন চণ্ডালের মুণ্ডু কেটে তার ওপর মূর্তি স্থাপন করেন। রুদ্র নারায়ণ ওই পাঁচ চণ্ডালকে অর্থ লোভে বশীভূত করে মুণ্ডু দিতে বাধ্য করেন। রাজার এই নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঢাকার প্রাদেশিক সুবেদার শাহবাজ খানের কাছে নালিশ যায়। সুবেদার এ ঘটনার বিচার করে রুদ্র নারায়ণকে মৃত্যুদণ্ডে দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য রুদ্র নারায়ণকে হাজার হাজার মানুষের সামনে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তবে খাঁচার মধ্যে তিনি লড়াই করে বাঘকে মেরে ফেলেন। এ খবর সুবেদারের কাছে গেলে তিনি রুদ্র নারায়ণের দণ্ড মওকুফ করে দেন। রুদ্র নারায়ণ তার কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে রাজবাড়িতে না ফিরে ছেলে নরোত্তম নারায়ণ রায়কে রাজত্ব দিয়ে কাশি চলে যান। সেখানে তিনি আমৃত্যু সন্ন্যাস জীবন পালন করেন।

রাজপ্রথা বিলুপ্তির পরে চালু হয় জমিদারি প্রথা। আর রুদ্র নারায়ণের উত্তরসূরিরা রাজা থেকে পরিণত হন জমিদারে। একসময় রাজবাড়িতে মহিষ বলি দিয়ে ঘটা করে কালী পূজা হতো। তবে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর রাজবাড়ি তার জৌলুশ হারায়। অত্যাচার নীপিড়নের অভিযোগের পাশাপাশি জনহিতকর কাজের জন্যেও এই রাজপরিবারের সুনাম রয়েছে। প্রজাদের পানীয়জলের সুবিধার জন্য তারা অনেক দিঘি খনন করে। সড়ক ও কাঠের সেতু নির্মাণ করেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজবাড়ির প্রধান ফটক, বসবাসের বহুতল ভবনগুলো, বিচারালয়, কাচারিঘর, জলসাঘর, অন্ধকূপ ভেঙে গেছে। মোগলদের মন্দিরের নকশায় নির্মিত মঠগুলো ক্ষয়ে গেছে। মঠের গায়ে শেওলা ও লতাপাতা জন্মেছে। নবরত্ন মঠসহ তিনটি মঠের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। একটি মঠে সংরক্ষিত আছে কষ্টিপাথরের মহামূল্যবান শিবমূর্তি।

রায়েরকাঠি শিব ও কালীমন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পিরোজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ওই রাজবংশের ২৯তম পুরুষ গৌতম নারায়ণ রায় চৌধুরী বলেন, ‘রাজবাড়ি ও মঠগুলো সংরক্ষণ করা খুবই ব্যয়বহুল। আর এই খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমরা বেশ কয়েকবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে এগুলো সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেও কোনো সাড়া পাইনি।’

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ