আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রতিদিনই মাদক বিক্রেতা আটক হলেও থামছে না এর বিস্তার। কারণ মাদক বিক্রি সিন্ডিকেট পরিচালিত হয় পরিবারকেন্দ্রিক। একজন আটক হলে অন্য সদস্য এর হাল ধরে। এতে নানা অভিযানের মধ্যেও অবাধে চলছে মাদক বিক্রি। এছাড়া গ্রাহক থেকে একসময় মাদক বিক্রেতা বনে যায় অনেকে। বিক্রেতারা বিত্তশালীর সন্তানদের টার্গেট করে। তাদের প্রথমে বিনামূল্যেও মাদক দেয়। যখন আসক্ত হয়ে পড়ে তখন টাকা জোগাড় করতে না পেরে বিক্রিতে নামে তারা।
জানা গেছে, নিজ ঘর থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধারের পর দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিল কক্সবাজার শহরের মধ্যম কলাতলী এলাকার রাসেল (২৮) ওরফে ইয়াবা রাসেল। আত্মগোপনে থাকলেও গত তিন মাস ধরে নিজ এলাকায় ফিরেছে রাসেল। এলাকায় ফিরে এক প্রকার প্রকাশ্যে নামি-দামি বাইকের মহড়া বসিয়েছিল এই ইয়াবা কারবারি। নিজের ইয়াবা সিন্ডিকেটদের সাথে প্রকাশ্যে এলাকায় মহড়া দিত তিনি। নতুন আস্তানা তৈরি করেছিল মধ্যম কলাতলী এলাকার একটি বহুতল ভবনের দ্বিতীয় তলায়। যেখানে ছিল ইয়াবা কারবারিদের আড্ডার স্থান। সেই শীর্ষ ইয়াবা কারবারি গত ২৪ মার্চ ছয় হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছে ঢাকায়। চকলেটের প্যাকেটে ইয়াবা পাচারকালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদও চালানো হয়েছে এই মাদক কারবারিকে।
তার সিন্ডিকেটে শুধু কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় ১৭ জনের নাম উঠে এসেছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। যার মধ্যে রয়েছে- তার সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য, ইয়াবা পাচারকারী, অর্থযোগানদাতা, ইয়াবা মজুদকারী, স্থানীয় শেল্টারদাতা, একজন কাউন্সিলর, দুইজন রাজনৈতিক নেতা ও কয়েকজন আত্মীয় স্বজন। তারমধ্যে কয়েকজনের নামে মাদক মামলা থাকলেও অধিকাংশ সদস্য মামলার বাইরে। মামলা না থাকলেও রাসেলের সাথে তারা ইয়াবা কারবারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে একটি সংস্থা। সংস্থাটি ইতিমধ্যে রাসেল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে।
তথ্যসূত্রে জানা গেছে- রাসেল সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছে তার আপন দুই মামা। ইতিমধ্যে একজন ইয়াবাসহ আটকও হয়েছিল। এরমধ্যে একজন রয়েছে জামাল। জামাল শহরের আলোচিত ইয়াবা কারবারি। ইয়াবা নিয়ে আটকও হয়েছিল। রয়েছে একাধিক মামলাও। অপরজন দেলোয়ার। সাগর পথে ইয়াবা পাচারের জড়িত জামাল ও দেলোয়ার। তাদের মাধ্যমে ইয়াবা কারবারিতে জড়িয়ে পড়ে রাসেল। রাসেলের আশ্রয়দাতা হিসেবে নাম উঠে আসে তার অপর মামা আমিনের। সাহাব উদ্দীন নামেও একব্যক্তির নাম রয়েছে রাসেল সিন্ডিকেটে। সাহাব উদ্দীনের বাড়ি টেকনাফে। সাহাব উদ্দীনের একভাইও ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকায় আটক হন। সাগর পথেও মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনেন সাহাব উদ্দীন। সাহাব উদ্দীনের বাড়ি টেকনাফ হলেও ইয়াবা কারবারের জন্য প্রায় সময় অবস্থান করে কক্সবাজার শহরে। ওসি প্রদীপের আমলে সাহাব উদ্দীনের পুরো পরিবার পালিয়ে আশ্রয় নেন কলাতলী ঝরঝরিপাড়া এলাকায়। ঝরঝরিপাড়ায় আশ্রয় নিয়ে গড়ে তুলেন বিশাল ইয়াবা সিন্ডিকেট। সাহাব উদ্দীনের পুরো পরিবারেই ইয়াবা কারবারে জড়িত বলে জানা গেছে।
মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর ফের টেকনাফ চলে যায় সাহাব উদ্দীনের পুরো পরিবার। টেকনাফের এই ইয়াবা ডন সাহাব উদ্দীন বিয়ে করেন মধ্যম কলাতলী ঝরঝরি এলাকার বদিউল আলমের মেয়েকে। বদিউল আলমের পুরো পরিবারও মাদক কারবারি। বদিউল আলম ও তার স্ত্রী রহিমা খাতুন এলাকায় খুচরা মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত। কলাতলীতে দুলাভাই সাহাব উদ্দীনের এসব ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করে শালা হিরু ও মাসেক। পুরো কলাতলীতে জনশ্রুতি রয়েছে বদিউল আলমের পরিবারের ইয়াবা কারবার নিয়ে। মধ্যম কলাতলীতে সাহাব উদ্দীনের শালা হিরু ও মাসুদ রানা ওরফে মাসেকসহ পুরো পরিবার ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। তবে বর্তমানে হিরু ও তার বন্ধু তানবির মিলে মাদক কারবারে জড়িত থাকলেও নিজেকে এই কারবার থেকে আড়াল করে রেখেছে মাসুদ রানা ওরফে মাসেক। স্থানীয় গাঁজা বিক্রেতা বশিরের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেন হিরু ও তানবির।
রাসেল সিন্ডিকেটে নাম রয়েছে- কলাতলী এলাকার আবু তাহের, রাসেলের পিতা শাসমুল আলম, মা ফাতেমা বেগম, রাসেলের আত্মীয় তৌহিদুল ইসলাম, কলাতলী এলাকার সাকিব, জব্বার, নাজুরা, বশির (গাঁজা বশির), আনোয়ার হোসেন, জয়নাল ও ফেম মাঝি। এছাড়া আরাফাত ও শাহাজান আনসারী নামে দুই ব্যক্তির নামও উঠে এসেছে রাসেল সিন্ডিকেটে। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে তিনজন নারীর নামও। কক্সবাজার পৌরসভার এক কাউন্সিলরও রাসেলের শেল্টারদাতা হিসেবে তথ্য উঠে এসেছে। রয়েছে কয়েকজন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তির নামও। এরমধ্যে ফেম মাঝির মাধ্যমে সাগর পথে ইয়াবা এনে খালাস করত মধ্যম কলাতলী এলাকার সাগরতীরে।
মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন- রাসেলের ইয়াবা সিন্ডিকেটটি দীর্ঘদিনের। তার কাছ থেকে অনেকের নাম পাওয়া গেছে। এরমধ্যে কলাতলী এলাকায় রয়েছে প্রায় ১৭ জনের নাম। কলাতলী এলাকা ছাড়াও কক্সবাজার শহরে তার সিন্ডিকেট ও শেল্টারদাতা রয়েছে। তারমধ্যে একজন কাউন্সিলরও। রাসেল সিন্ডিকেটের প্রতিটি সদস্য নজরদারী রয়েছে। রাসেল গ্রেপ্তারের পর অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। বর্তমানে কারাগারে রয়েছে রাসেল।
সূত্রে জানা গেছে, তাদের ইয়াবা খালাসের মূল পয়েন্ট হল কলাতলী মেম্বারের নৌকার ঘাটটি। যে পয়েন্ট দিয়ে রাসেল সিন্ডিকেটসহ অনেক ইয়াবা কারবারি মাদক খালাস করে নিয়মিত।
জানা যায়, গত বছরের ৮ মে মধ্যম কলাতলী এলাকায় রাসেলের বাড়ি থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে সদর থানা পুলিশ। এই ঘটনায় রাসেলের মা ফাতেমা বেগম (৪০) ও তার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম (২২) কে আটক করলেও কৌশলে আরো বিপুল পরিমাণ ইয়াবা নিয়ে পালিয়ে যায় রাসেল ও তার বাবা শামসুল ইসলাম। এই ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় মামলার অন্যতম আসামী হন রাসেল ও তার বাবা শামসুল ইসলামও।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ