ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের নারকীয় তান্ডবের এক বছর পার হলেও এসব ঘটনায় দায়েরকৃত ৫৬টি মামলার মধ্যে একটি মামলারও আদালতে অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। তবে দ্রুত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। এদিকে তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্থ অনেক প্রতিষ্ঠানই ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মানুষের মনে এখনো রয়েছে সহিংসতার আতঙ্ক ও ভয়ের ছাপ। তান্ডবের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশ আসামী জামিন পাওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
মহান স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনের প্রতিবাদে গত বছরের (২০২১ ইং) ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নারকীয় তান্ডব ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, রেলওয়ে স্টেশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, জেলা মৎস্য অফিস, সার্কিট হাউজ, জেলা পরিষদ কার্যালয় ও ডাকবাংলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব, খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ভবন, আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, মাতৃ সদন, এসিল্যান্ডের কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের কার্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কালীবাড়ি, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের বাসভবন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির বাসভবন, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বাসভবনসহ প্রায় অর্ধশতাধিক সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ করে।
এসব ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন থানা ও আখাউড়া রেলওয়ে থানায় মোট ৫৬টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে সদর মডেল থানায় ৪৯টি, আশুগঞ্জ থানায় ৪টি, সরাইল থানায় ২টি ও আখাউড়া রেলওয়ে থানায় ১টি মামলা দায়ের করা হয়। ৫৬টি মামলার মধ্যে ১০টি মামলা সিআইডি, ৯টি মামলা পিবিআই, সদর মডেল থানার পুলিশ ২৭টি, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ৪টি, আশুগঞ্জ থানায় ৩টি, সরাইল থানায় ২টি ও আখাউড়া রেলওয়ে পুলিশ ১টি মামলা তদন্ত করছে।
জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ি, হেফাজতের তান্ডবের ঘটনায় দায়েরকৃত ৫৬টি মামলায় এজাহারনামীয় ৪৬ জনসহ মোট ৭৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ৬৩৮ জন ইতিমধ্যেই জামিনে কারামুক্ত হয়েছে এবং বাকী ১২০ জন বর্তমানে কারাভোগ করছেন। জেলা পুলিশের কাছে তদন্তাধীন ৩৬ টি মামলায় ৪৯ জন আসামী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেছেন।
এদিকে ভয়াবহ তান্ডবের পর ঘটনার নেপথ্যের নায়কেরা এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় সচেতন মহলের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে আবরনি আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক শারমিন সুলতানা বলেন, মহান স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান চলাকালে গত বছর ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা যে তান্ডবলীলা চালিয়েছে তার নিন্দা করার ভাষা আমার নেই। এটা নজিরবিহীন তান্ডব। ওইদিন তারা টার্গেট করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে থাকা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তান্ডবের নেপথ্য নায়করা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমি তাদের বিচার দাবি করছি।
জেলা জাসদের সভাপতি অ্যাডভোকেট আক্তার হোসেন সাঈদ বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলাম যে তান্ডবলীলা চালিয়েছিল আমরা সেটা ঘৃণা করি। তাদের যে ধরণের বিচার হওয়ার কথা ছিল আমরা তা দেখতে পাইনি। এখানে কোনো আপোষ কামিতা কাজ করছে কিনা, সেটা সন্দেহের বিষয়। যতদিন তাদেরকে বিচারদের আওতায় না আনা হবে, ততদিন স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদেরকে প্রতিহিত করার আহবান জানাই।
এ ব্যাপারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহবায়ক অ্যাডভোকেট আবদুন নূর বলেন, একটা অপসংস্কৃতি চলছে। ২০১৬ সালেও মাদরাসার ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলেছিল তান্ডব। একই বছরের নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। সে সব ঘটনার কোন বিচার হয়নি। ওই সব ঘটনার বিচার হলে ২০২১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তান্ডবের ঘটনা ঘটতো না। তিনি বলেন, আমরা শঙ্কিত। শঙ্কিত এই জন্য, এসব ঘটনার বিচার দেখে যেতে পারব কিনা। আমরা চাই এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হউক।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট মোঃ নাজমুল হোসেন বলেন, হেফাজতের হামলার ঘটনায় সবগুলো মামলাই তদন্তাধীন রয়েছে। জাতি এই ঘটনার বিচার চায়। আমিও একজন আইনজীবী হিসেবে তাদের বিচার চাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোনো মানুষ অপরাধ করে পার পায়নি। তিনি বলেন, কেউ বিনা বিচারে পার পাবেন না। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আল-মামুন সরকার বলেন, হামলার ঘটনায় যদি বিচার না হয় তাহলে আবারও এর পুনরাবৃত্তির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করেছে স্বাধীনতা বিরোধীদের ইন্ধনে। আমার কাছে মনে হচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে ওই চক্রটি একটা মরণ কামড় দিবে। তারা আবারও একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন বলেন, তান্ডবের ঘটনায় থানায় দায়েরকৃত মোট ৫৫ টি মামলায় এখন পর্যন্ত ৭৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩৮ জন আাসামী আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে এসেছেন। ১২০ জন এখনো জেল হাজতে আছে। আমরা মামলার গুলো সতর্কভাবে তদন্ত করছি। এখন পর্যন্ত কোনো মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। তদন্ত কার্যক্রম শেষ হলেই আমরা মামলা গুলোর চার্জশীট আদালতে জমা দেব।
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, পুলিশ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঘটনাগুলো তদন্ত করছে এবং তদন্ত কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়ে গেছে। পুলিশ মামলাগুলো নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে স্থিতিশীল রাখতে করণীয় সবই করা হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/এমআরএইচ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ