২০০৯ সালের ঘুর্ণিঝড় আইলার পর থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল জুড়ে নিরাপদ পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিগত কয়েক বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষের মধ্যে সুপেয় পানি সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
চলতি খরা মওসুমে এই সংকট এতটাই বেড়েছে যে, এখন গ্রামের মানুষ কলসি নিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছে এমনকি সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলের কমপক্ষে ৪০ লাখ মানুষ পুকুরের পানি ও নদীর নোনা পানি খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার এসব তথ্য দিয়েছেন সাতক্ষীরার কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, সরকারি হিসাব অনুযায়ী খুলনার ২২ শতাংশ, বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ এবং সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে সরকারিভাবে এমন কথা বলা হলেও বাস্তবে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। পানি সংকট নিরসনে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে উপকূল জুড়ে খাবার পানির জন্য পুকুর খনন, টিউবওয়েল স্থাপন, পন্ডস এন্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতেও এই সংকট দূর হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা। সাতক্ষীরা জেলার ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮১ জন মানুষের মধ্যে উপকূলের ৫ লক্ষাধিক মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে রয়েছে। গ্রামের নারীরা কয়েক কিলোমিটার দূরে যেয়ে প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করার চেষ্টা করে আসছেন।
সাতক্ষীরা উপকূলের মুন্সিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার আগে আমাদের এলাকায় পানি সংকট খুব একটা ছিলো না। ২০০৯ সালের পর থেকে এলাকায় লবণাক্ততা বেশি দেখা দিয়েছে। সুপেয় পানির সংকটও তীব্র হয়েছে। এই মৌসুমে পানি সংকট আরও প্রকট হবে।
শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালী ইউনিয়নের দাতিনাখালী এলাকার শেফালী বেগম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় খাওয়ার পানির খুবই সমস্যা। দুই তিন কিলোমিটার দূরে কলসি নিয়ে পানি আনতে যেতে হয়। সেখানে যেয়ে আবার লাইনে দাঁড়াতে হয়। খাবার পানি সংগ্রহ করতে দিনের তিন-চার ঘণ্টা চলে যায়। খরা মওসুমে আমাদের এলাকায় পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। ২০০৯ সালের পর থেকে পানি সংকট সমস্যার সমাধান হলো না। পানির জন্য এই কষ্ট কবে যে দূর হবে তা জানিনা।’
শ্যামনগরের আটুলিয়া ইউনিয়ন হাওয়ালভাঙ্গি গ্রামে পানী আপা নামে পরিচিত শেফালী খাতুন বলেন, যে সমস্ত বাড়িতে পানির ফিল্টার আছে, সেগুলো পরিস্কার করে ও সদস্যদের শিখিয়ে দেন কিভাবে পানির ফিল্টার পরিস্কার করতে হয়। সকলের কাছ থেকে ফিল্টার ঠিক করা বাবদ ২০ টাকা নেন তিনি। কোথাও পিএসএফ ফিল্টার পরিস্কার করা, পারিবারিক ফিল্টার পরিস্কার করে যেটুকু অর্থ তিনি পান তা দিয়ে তিনি সংসার চালান।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে একটি স্ক্রু ড্রাইভার নিয়েই পানির ফিল্টার ড্রাম বিএসএফ ঠিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। পরে বেশকিছু সদস্য তৈরি করে কিভাবে পানি ধরতে হয়, কিভাবে ফিল্টার পরিষ্কার করতে হয়, সেটা ভালোভাবে আলোচনা করেন। সুপেয় পানি সংকট নিরসনে এলাকার মানুষের সাথে তিনি আলোচনা করেন। পানির ট্যাংক পরিষ্কার ও ফিল্টার পরিষ্কার করার প্রতি উপকার ভোগীদের তেমন একটা গুরুত্ব দিত না। তবে ফিল্টার এর মধ্যে বা পানির ট্যাংক এর মধ্যে যে ধরনের ময়লা জমে সেগুলো পরিষ্কার করার বিষয়ে এলাকার মানুষের আগ্রহ বাড়লে পরিস্কার করার চাহিদা তৈরি হয়। বর্তমানে হাওয়াভাঙ্গি এলাকার মানুষ প্রতিবছর পানি ধরার বর্ষা মৌসুমের আগে পানির ফিল্টার, ড্রাম ও পিএসএফ পরিস্কার করার জন্য পানি আপা শেফালী খাতুনের কথা মনে করেন। এই কর্মকাণ্ড বড় একটি অংশ দেখতে না পেলেও সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে কিছুটা উন্নতি দেখে দিয়েছে পানি আপার। গ্রামের আরো কিছু নারীরা কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে পানি পরিস্কার করার কৌশল ও বিষয়গুলি নিয়ে এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ফিল্টার মেরামত করে পানি আপা শেফালী খাতুন প্রতিমাসে ২৪শ’ থেকে ২৫শ’ টাকা আয় করেন। বিশ্ব পানি দিবস উপকূলবাসীর প্রাণের দাবি সুপেয় পানির সংকট নিরসনে প্রতিটি পরিবারে পৌঁছে দিতে সরকারের কাছে দাবি জানান শেফালী খাতুন।
বেসরকারি সংস্থা (লীডার্স) এর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন, ‘খাবার পানির এই সংকট দূরীকরণে আরও প্রকল্প হাতে নেওয়া দরকার। বিশেষ করে পুকুর খনন, পিএসএফ স্থাপন, টিউবওয়েল স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের আরও বড় বড় প্রকল্প গড়ে তোলা দরকার।’
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আইলার পর থেকে সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানি সংকট রয়েছে। সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ ও পানির বড় ট্যাংকের ব্যবস্থা আছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সরকারি এবং বেসরকারি পানির ট্যাংকি প্রদান করা হয়েছে। যেসব এলাকার গভীর নলকূপ থেকে লোনা পানি উঠৈ সেসব এলাকায় পুকুর কেটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাতক্ষীরা উপকূলে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করছে এবং খাবার পানির আঁধারগুলো নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া সাতক্ষীরা উপকূলের সব স্থানে গভীর নলকূপ সাকসেস হয় না। যেসব এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করা দরকার সেখানে নলকূপ স্থাপন করা হচ্ছে। এলাকার গভীর নলকূপ থেকে লোনা পানি উঠৈ সে সব এলাকায় পুকুর কেটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে সব এলাকায় লবণাক্ততা বেশি সে এলাকায় আরও প্লান্টের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মাধ্যমে কমিউটিনি বেশ রেইন ওয়াটার হারবেস্টিং ওয়াটরের কার্যক্রম চলমান আছে সাতক্ষীরা আশাশুনি ও শ্যামনগর উপকূলে। এটিএম থেকে দশ পয়সা দিয়ে প্রতি লিটার পানি নিতে পারবে ২৫ থেকে ৫০টি পরিবার। আশা করছি খুব দ্রুত এই অঞ্চলের পানি সমস্যার সমাধান হবে।’
সাতক্ষীরা জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আ. বাছেদ জানান, সাতক্ষীরা জেলা সমুদ্র উপকূলীয় জেলা হওয়ায় প্রতিবছর বিভিন্ন দুযোর্গের মুখোমুখি হচ্ছে। সুপেয় পানি লবণাক্ততা দিন দিন বড় সমস্যা হয়ে দাড়াচ্ছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে কাজ করছে।
এদিকে সোমবার দুপুরে দক্ষিণ উপকূলের কোটি মানুষের জন্য সুপেয় পানি চাই এই স্লোগান তুলে পানির কলসি নিয়ে মানববন্ধন করেন সাতক্ষীরাবাসি। চারদিকে নোনা পানি অথচ এতটুকু পানি খাবার জোঁ নেই এমন অবস্থা থেকে আমরা রক্ষা পেতে চাই উল্লেখ করে মানববন্ধনে নারী ও পুরুষ বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশের ৮৩৪ বর্গকিলোমিটার উপকূল কোন এক সময় পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশংকার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আর এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
সোমবার দুপুরে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের চত্বরে অনুষ্ঠিত আড়াই ঘণ্টার এই মানববন্ধনের ডাক দেয় জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরাম। এতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি এবং সদর উপজেলা সহ কয়েক এলাকার শতশত নারী পুরুষ যোগ দেন। তারা পানিশূন্য কলসি রেখে বিক্ষোভ দেখান।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ