ঢাকা, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সরকারি স্কুলে ১০ টাকার বেতন ৬০০ টাকা নেয়ার অভিযোগ

প্রকাশনার সময়: ১৪ মার্চ ২০২২, ২১:২১

সরকারি স্কুলে ঢালাও ভাবে সকল শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে দশ টাকার বেতনের বদলে ৬০০ টাকা বেতন নিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলামের দাবি আইন মেনেই নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ক্লাস এবং অতিরিক্ত মাসিক ফি ১২০০ টাকার পরিবর্তে নেয়া হচ্ছে মাত্র ৬০০ টাকা। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পুরো বছরই অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া হবে। অন্যান্য স্কুল গুলোতে এভাবেই অতিরিক্ত ক্লাসের জন্য আরো বেশি টাকা নেয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

প্রধান শিক্ষকের কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও স্কুলের সভাপতি ইউএনও মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ।

তারা বলছেন, বেআইনি ভাবে অতিরিক্ত ক্লাস সকল শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে টাকা নেয়া বেআইনি। দূর্বল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিশেষ ক্লাস নিতে পারে। তবে কারো উপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায় হবে। ১৫ তারিখ পর পুরো সপ্তাহ স্কুল খোলা থাকবে। তখন কিভাবে অতিরিক্ত ক্লাস নিবে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপিঠ সরকারি কে.বি পাইলট মডেল হাইস্কুল। গতবছর স্কুলটি সরকারীকরণ করা হয়েছে। সরকারি হওয়ার পর করোনা মহামারির কারণে সরকারি নির্শেনা অনুযায়ী সপ্তাহে একদিন ক্লাস হতো। কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভালো রেজাল্টের অজুহাত দেখিয়ে সপ্তাহে আরও অতিরিক্ত পাঁচদিন ক্লাস বাধ্যতামূলক করেন। অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অভিযোগ না থাকলেও প্রতিমাসে দশ টাকা বেতনের সাথে আরও অতিরিক্ত বেতন হিসেবে ৬০০ টাকা পরিশোধে বাধ্যতামূলক করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে গরীব ও অসহায় সাধারণ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মাঝে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় , প্রতিটি শ্রেণির তিনটি শাখায় ৬০ জন করে মিলে ১৮০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণীতে পড়াশোনা করেন প্রায় ৯০০ শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর আর্থিক অবস্থা অনেক দূর্বল। তাদের সরকারি বেতন মাসে দশ টাকা। কিন্তু বর্তমানে ওই স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন বাবদ ৬০০ টাকা ও পরীক্ষা ফিস বাবদ ৫০ টাকা করে পরিশোধ করার জন্য আগামী ২২ জানুয়ারি সময় দেয়া হয় শিক্ষার্থীদেরকে। তবে যারা ৬৫০ টাকা বেতন না দিবে তাদের টিসি দিয়ে বের করা এবং এস্যাইনমেন্ট খাতা জমা না নেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখানো কারণে এসব বিষয় নিয়ে ভয়ে শিক্ষার্থীরা সরাসরি প্রতিবাদ করতে পারছেনা বলে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের দাবি।

৬ষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত তিন মাসের সিট দিয়েছে এক্সট্রা ক্লাসের। প্রতি মাস শেষে এই সিটের মধ্য থেকে পরীক্ষা নেয়া হবে বলা হয়েছে স্কুল থেকে। এই পরীক্ষার জন্য ৫০ টাকা ফি দিতে হবে এবং এক মাস ক্লাসের জন্য সাথে আরো ৬০০ টাকা দিতে হবে ।

সপ্তম শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থী বলেন, সকাল সোয়া ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আমাদের তিনটা ক্লাস হয়। আর এই ক্লাসগুলো এক্সট্রা ক্লাস হিসেবেই করানো হয়। যদি কেউ এক্সট্রা ক্লাস করতে না আসে তাহলে স্যাররা বলে টিসি নিয়ে চলে গিয়ে অন্য স্কুলে চলে যেতে। এছাড়া দশম শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা যদি এক্সট্রা ক্লাস না করি তাহলে আমাদের অ্যাসাইমেন্ট জমা নিবে না বলা হয়েছে। এমনকি এক্সট্রা ক্লাস শুরু হওয়ার পর যারা ক্লাস করতে আসেনি তারা শ্রেণি শিক্ষকের কাছে তাদের অ্যাসাইমেন্ট জমা নিবেনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, তার দুই সন্তান সরকারি কেবি পাইলট হাইস্কুলে পড়াশোনা করছে। রাজমিস্ত্রি স্বামীর পক্ষে সংসার চলানো যেখানে দায় সেখানে অতিরিক্ত ক্লাসের নামে ৬০০ টাকা করে মাসিক বেতন দেয়া সম্ভব নয়। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ও স্কুলের বেতন নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ভেবে ছিলাম বড় ছেলেকে যখন সরকারি স্কুলে ভর্তি করাইছি তাহলে কম টাকায় পড়াতে পারব। এখন দেখি মরার উপর খারার ঘা। অতিরিক্ত ক্লাস বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদ জানান ভুক্তভোগী ওই অভিভাবক।

আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, তার স্বামী চা বিক্রি করে সংসার চালায়। প্রতিমাসে দশ টাকার বেতন ৬৫০ টাকা করায় সন্তানকে পড়ালেখা করানোই এখন দায়। আরো একাধিক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা জানান, স্কুলে অনেক শিক্ষার্থী আছে যাদের পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল। সরকারি স্কুলে মেধার ভিত্তিতে ভর্তি করেও সরকারি স্কুলে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হচ্ছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উপর জোরপূর্বক এক্সট্রা ক্লাস চাপিয়ে দিয়েছে এবং সরকারি বেতনের বাহিরে অতিরিক্ত বেতন নির্ধারণ করেছে ৬০০ টাকা। যা সবার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। অতিরিক্ত ক্লাসের নামে হয়রানি বন্ধের দাবি জানান তারা।

এই বিষয়ে ভৈরবে সরকারি কে. বি পাইলট মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে আড়াই বছর ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার বিঘ্ন ঘটে। আর এই আড়াই বছর পড়ালেখা থেকে দূরে থাকাতে তাদের যে ঘাটতি হয়েছে এই ঘাটতিটা পূরণের জন্য ও পড়াশোনার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি আইন মেনেই আমি আমার স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে স্কুলের ক্লাসসমূহের বাহিরে অতিরিক্ত সময়ে এই এক্সট্রা ক্লাসের ব্যবস্থা করেছি যেন ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার মান ও রেজাল্ট ভালো হয়। শিক্ষার্থীদের ভালো রেজাল্টের জন্য এই এক্সট্রা ক্লাসটা পুরো বছরই চলবে বলে জানান। তিনি আরো বলেন, সরকার নির্ধারিত অনুযায়ী যে ফি ধার্য ধরা আছে তা আমরা নিচ্ছিনা। সরকারি ফির অর্ধেকের চেয়ে আরো অনেক কম নিচ্ছি।সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সপ্তাহে ৩ দিন ক্লাস করালে মাসে ১২০০ টাকা ফি ধার্য করা আছে। আর আমি সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস করিয়ে পরীক্ষার ফিসহ ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করেছি। তবে যারা ফি দিতে অক্ষম তারা অবহিত করলে ফি মওকুফ করা হবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এম আবু ওবায়দা আলী মুঠোফোনে জানান, আইনগতভাবে উনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারেনা। মনগড়া ভাবে সরকারি স্কুলে কিভাবে নেয়। কোন পরিপত্র আছে কিনা প্রধান শিক্ষককে দেখাতে বলেন। বিষয়টি ইউএনও মহোদয়কে অবগত করার পরামর্শ দেন তিনি।

সরকারি কেবি পাইলট মডেল হাইস্কুলের স্কুলের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ বলেন, যদি বেআইনি ভাবে অতিরিক্ত ক্লাসের নামে টাকা নেয় সেটা দুঃখজনক। দূর্বল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিশেষ ক্লাস নিতে পারে। নিজের ইচ্ছাতে যদি কোন শিক্ষার্থী ক্লাস করতে চাই সেটা অন্য বিষয়। তবে কারো উপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন বলে জানান।

নয়া শতাব্দী/এমআরএইচ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ