কক্সবাজারে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সংগঠিত হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। ক্রয়-বিক্রয়, সেবন ও পাচার কাজে ফেসবুকসহ অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে দুষ্কৃতিকারীরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানবিক ও সৃজনশীল গ্রুপে জায়গা করে নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকা এসব ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশলে ফাঁদে ফেলে শিকারে পরিণত করছে সহজ সরল এবং অনলাইনে অনভিজ্ঞ ব্যবহারকারীদের। প্রতারক এবং মাদক ব্যবসায়ী চক্রের এসব লোকজন নিজেদের কখনও রক্তদাতা সংগঠক আবার কখনওবা উদ্যোক্তা পরিচয় দিয়ে নিজেদের পরিচ্ছন্ন ইমেজে জাহির করেন সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে। আবার কেউ কেউ ভাগ্য বলে পাওয়া রূপ লাবণ্য ও চাকচিক্য প্রদর্শন করে সাধারণ সদস্যদের সাথে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে ফাঁদে ফেলছেন সরল বিশ্বাসের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট যেকোনো সংস্থার নজর এড়িয়ে অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছে এই দুষ্কৃতিকারী চক্র।
টেকনাফের সাবরাং কচুবনিয়া এলাকার ছৈয়দ আহমদের ছেলে আবু তৈয়ব (২২)। উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী ফেসবুকে সক্রিয় একটি রক্তদাতা সংগঠনের চক্রে যুক্ত হন বছর দুয়েক আগে। কক্সবাজার শহরে বসবাসকারী ওই চক্রের অপর এক তরুণী সদস্যা ফারজানার (ছদ্মনাম) সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে তার। আমন্ত্রণ পেয়ে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ওই তরুণীর জন্মদিন উপলক্ষে কক্সবাজার বেড়াতে আসলে সেখানে পরিচয় ঘটে নিছা (২৮) নামে এক কথিত অনলাইন উদ্যোক্তার। নিছা ওই তরুণীর সম্পর্কে মামী হন। নিজেকে স্বনামধন্য নারী উদ্যোক্তা পরিচয় দিয়ে টেকনাফের আবু তৈয়বের সাথে পরিচয়ের গোড়াপত্তন ঘটায়। এভাবে দীর্ঘ ৩মাস পর্যন্ত চলে তাদের মধ্যে বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন ব্যবসায়ীক লেনদেন। সম্পর্কের এক পর্যায়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি (রবিবার) ঘটে যায় বিপত্তি। নিছার নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত তৈয়বকে কক্সবাজারে ডেকে এনে তার সাথে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ও ডিএসএলআর ক্যামেরাসহ কমপক্ষে সাড়ে ৩লাখ টাকার মালামাল হাতিয়ে নেয়। এনিয়ে দুই পক্ষের মাঝে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হলে উভয়পক্ষ সামাজিক ভাবে মীমাংসার জন্য কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার মিজান নামে এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির দ্বারস্থ হন।
তৈয়বের দাবি-ঘটনার দিন তিনি চিকিৎসার জন্য কক্সবাজারে এসেছিলেন। কিন্তু যথাসময়ে ডাক্তার দেখাতে না পেরে অভিযুক্ত নিছার বাড়ির নিকটবর্তী আবাসিক হোটেল টেকপাড়ার হোটেল বানুপ্লাজায় ৩০৮ নাম্বার কক্ষে অবস্থান করেন। সেখানেই তিনি নিছা ও তার পরিবার কর্তৃক হামলা ও তার সাথে থাকা নগদ টাকা মালামাল লুটের শিকার হন।
তৈয়ব প্রতিবেদককে আরও জানান, ‘আমার বাড়ি টেকনাফ পরিচয় পেয়ে নিছা আমার সাথে রহস্যজনক ভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলে। সম্পর্কের শুরু হতে না হতেই নিছা আমাকে ইয়াবা ব্যবসার প্রস্তাব দেয়। আমি তার প্রস্তাব নাকচ করি। এরপরও সে আমাকে এই ব্যবসার জন্য বাধ্য করে। আমিও তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি।”
কিন্তু এত সুসম্পর্ক থাকা সত্যেও কেনো নিজেদের মধ্যে মালামাল কেড়ে নেওয়ার মতো অঘটন ঘটেছে জানতে চাইলে তৈয়ব এর কোনো জবাব দিতে পারেনি।
তৈয়বের আরও অভিযোগ- ঘটনার দিন নিছার সাথে একদল পূর্বপরিচিত লোকজন এসে তাকে আতিথেয়তার কথা বলে হোটেল বানু প্লাজা থেকে বের করে নিছার বাড়িতে নিয়ে যায়। নিছার বাড়িতে প্রবেশ করার পরপরই হঠাৎ ফোন করার কথা বলে হাত থেকে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয়। একটু পর খুহাব নামের একজন এসে ২ লক্ষ টাকা দাবি করে বসে। “টাকা দিতে না পারায় আমার কাছ থেকে ২টা মোবাইল, একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা, ৪ আনা ওজনের একটা স্বর্ণের রিং এবং নগদ ৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়।” সেখানে উপস্থিত ছিলেন নিছার পিতা রেজাউল করিম, মাতা লিলি, ভাই খুহাব ও নিছা নিজে। কিন্তু এতো মালামাল নিয়ে কেনো তিনি সেদিন কক্সবাজারে গিয়েছিলেন এই প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
এদিকে তৈয়বের অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগযোগ করা হয় নিছা ও তার পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সাথে। উপর্যুপরি কল দিয়েও নিছার মুঠোফোনে সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে নিছার মা লিলি ফোন রিসিভ করে তৈয়বের যাবতীয় অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করেন। পরে ঘটনার বিভিন্ন বিষয়ে সচিত্র তথ্য প্রমাণ তুলে ধরা হলে দায় স্বীকার করে তার স্বামী তথা নিছার পিতা রেজাউলের কাছে ফোনটি হস্তান্তর করেন বিস্তারিত জেনে নিতে অনুরোধ করেন।
রেজাউলের দাবি- তৈয়ব একজন ইয়াবা সরবরাহকারী যুবক। সে বিভিন্ন সময় তাকে ইয়াবা সরবরাহ করেছে। তবে সেটি শুধুমাত্র সেবনের জন্য; বিক্রির জন্য নয়। এছাড়াও তৈয়ব তার স্ত্রীকে মা ডেকে এর আগে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। ওই টাকাও সে পরিশোধ করেনি। এছাড়াও মালামাল লুটের বিষয়টিও সঠিক নয়। সে মিথ্যা বলছে। এক্ষেত্রেও কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করলে পরে তৈয়বের মালামাল কেড়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন এবং ফিরিয়ে দিবেন বলেও দাবি করেন প্রতিবেদকের কাছে। তবে একজন স্বল্প পরিচয় ভিন্ন এলাকার যুবকের কাছে এতো টাকা ধার দেওয়ার কারণ কি জানতে চাইলে প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অনলাইন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও নিছা ইতিপূর্বেও একাধিক অনলাইন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতারণা করেছেন। গত বছরও চকরিয়ার এক ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা নিছার কাছ থেকে প্রতারিত হলে একটি মীমাংসা বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিলো। অন্যদিকে তৈয়ব সরাসরি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টিও একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভদ্র সজ্জন মুখোশের আড়ালে তৈয়ব একজন চালাক চতুর মাদক ব্যবসায়ী।
তৈয়বের পূর্ব পরিচিত ফারজানাও (ছদ্মনাম) দাবি করেন- তার মামী নিছা ও তার লোকজন তৈয়বের কাছ থেকে মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে এটা শতভাগ সত্য। কিন্তু তৈয়বও তাকে না জানিয়ে তার মামীর সাথে যে রহস্যজনক সম্পর্ক তৈরি করেছে এটাও কোনো ভাবেই স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার মতো নয়। নিশ্চয় তৈয়বও কোনো না কোনো অপকর্মের সাথে জড়িত বলেই তাকে না জানিয়ে তার মামী নিছা ও তার পরিবারের সাথে একটি গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এখন ভুক্তভোগী হবার পর আবার তার সাহায্য চাইছে বলেও আক্ষেপ করে জানান।
এঘটনায় কক্সবাজার শহরের টেকপাড়া এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি লায়ন মিজানুর রহমান জানান, মাদকের কারণে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। অনলাইন কেন্দ্রিক প্রতারণাও বেড়েছে। এছাড়াও মাদক ব্যবসায়ীরা নিরবে সক্রিয় হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মাদকের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সক্রিয় নজরদারী কামনা করেছেন তিনি।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ