ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কেশবপুরে সন্ত্রাসীদের দাপটে আতঙ্কে মানুষ

প্রকাশনার সময়: ০৪ মার্চ ২০২২, ০৩:৫৫

কেশবপুরে ভয়াভহ রুপ ধারণ করেছে সন্ত্রাসী চক্র। জমি দখল, ঘের দখল, যৌন হয়রানি, মাদক ব্যবসা ও মাদক গ্রহণ, চাঁদাবাজি, কুপিয়ে জখম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, খুন ও গুমের হুমকি ধামকিসহ সমাজের অপরাধ জগতের এমন কাজ নেই যা তারা করছেন না। তাদের ভয়ে অনেকে এলাকাছাড়া, আবার কেউ কেউ ব্যবসা বাণিজ্য গুটিয়ে দেশান্তরি হয়েছেন। সাংবাদিক, নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দরাও পার পাচ্ছেন না। এমনকি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষকে মারপিট করতেও পিছপা হচ্ছে না এসব অপরাধীরা। তাদের দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দিলে তার উপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে মারপিট ও প্রাননাশের হুমকি প্রদান করছে তারা। চক্রটি কেশবপুরবাসীর জন্য ভয়ানক এক আতঙ্ক। চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা একের পর এক থানায় অভিযোগ দিচ্ছেন। মামলা হচ্ছে একের পর এক কিন্তু অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোয়ার বাইরে। চক্রটি শহরজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আর মামলার বাদীরা অনেকেই ঘরছাড়া।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্থানীয়রা। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় থাকায় পুলিশ এ্যাকশান নিতে গেলেই ওই নেতা বাধা হয়ে দাড়াচ্ছেন। কেশবপুরবাসী এ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পুলিশের উর্দ্ধতন মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, কেশবপুর পৌরশহরের আতঙ্ক দুধর্ষ সন্ত্রাসী জামাল বাহিনী প্রধান শেখ জামাল দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দাবি করে আসছে। বিএনপি পরিবারের সন্তান জামাল একসময় অটো চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। কয়েক বছর ধরে সে পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলামের আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে সন্ত্রাসীবাহিনী গঠন করে রাজত্ব কায়েম করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মধ্যকুল গ্রামের শেখ আব্দুল গণি শেখের ছেলে বাহিনী প্রধান শেখ জামাল (২৫)সহ সহযোগী হিসেবে রয়েছে একই এলাকার মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে শামীম হোসেন (২৩), মকবুল হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম, মৃত আব্দুল মজিদ দফাদারের ছেলে জুয়েল হোসেন, ভোগতি নরেন্দ্রপুর গ্রামের রহিম মোড়লের ছেলে আরিফুর রহমান (২৮), আলতাপোল উপজেলা পাড়ার কামরুজ্জামানের ছেলে মাহি রহমান (২০)। এদের সাথে বিভিন্ন এলাকার আরো ১০/১৫ জন কিশোর রয়েছে। জামালের নামে ৭টি মামলাসহ তার সহযোগীদের নামে কেশবপুর থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। উপজেলা ও পৌর এলাকার সব অপরাধেই সামনের সারিতে থাকে এসব অপরাধীরা।

বুধবার শহরের ত্রিমোহিনীর মোড়ের আমার ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্টে চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় জামাল ও তার বাহিনীর সদস্যরা বায়সা এলাকার আবু তাহেরকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। এঘটনার পরই দুই পক্ষ মহড়া দেয়া শুরু করলে শহরে অতংক ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে কেশবপুর থানায় মামলা হয়েছে। যার নং-০১। মামলা হলেও অদ্যবধি কেউ আটক হয়নি।

এ ঘটনার এক সপ্তাহ পূর্বে পৌর শহরের পুরাতন বাসষ্ট্যান্ড এলাকার পায়েল এ্যালুমুনিয়ামের মালিক সাধন সাহার কাছে ১০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে জামাল বাহিনীর সদস্যরা। চাঁদার টাকা না দেয়ায় তাকে প্রকাশ্য দিবালকে মারপিট করে তারা। গুরুতর আহত অবস্থায় সাধনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে তার হার্টের অপারেশন করাতে হয়। এতে সাধনের প্রায় ৪ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়েছে। এতকিছুর পরো ভয়ে তিনি মামলা করেন নি।

কেশবপুর বাজারের হাসপাতাল রোডের মুদি ব্যবসায়ী সাহাপাড়া এলাকার অলোক সাহার ছেলে অনিক সাহা পৌরশহরের আতঙ্ক সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের হামলার শিকার হয়ে থানায় মামলা করেন। মামলায় বাহিনী প্রধান জামালসহ আরো ৫জনকে আসামি করা হয়।

মামলায় অনিকের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে একলাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিল ওই চক্র। একপর্যায়ে গত বছরের ২৭ আগস্ট জামাল ও গ্রামের শামীম হোসেন, সাইফুল ইসলাম, জুয়েল হোসেন, মাসুদ হোসেন, মাহি রহমান সহ অজ্ঞাত ৮-১০ জন তার দোকানে হাজির হয়। মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়, তাদের কাছে হকিস্ট্রিক, লোহার রডসহ বিভিন্ন অস্ত্রছিল। দোকান বন্ধ পেয়ে অনিকের বাসার সামনে চলে যায় তারা। দুপুর তিনটায় তাদের মধ্যে শামীম ০১৩.....৬৩ নাম্বার থেকে কল করে কৌশলে অনিককে ফোন করে ডেকে আনে। এরপর জামাল সেই চাঁদার একলাখ টাকা দিতে বলে। চাঁদার টাকা না দেওয়ায় অনিককে প্রথমে মোটরসাইকেলে তুলে অপহরণের চেষ্টা করে। এরপর অন্য আসামিরা অনিককে লোহার রড দিয়ে আঘাত করে গুরুতর জখম করে। এ হামলায় অনিকের ডান হাত ভেঙ্গে যায়। অনিকের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসলে জামাল গং চাদার একলাখ টাকা নাদিলে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়। পরে পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।

এ ঘটনায় গত বছরের ২৯ আগস্ট কেশবপুর থানায় অনিক একটি মামলা করেন। যার নং-১৩/১২৭। হিন্দু যুব মহাজোটের জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ জড়িতদের আটকের দাবিতে প্রেসক্লাব যশোরের সামনে মানববন্ধনও করেন। কিন্তুকেউই আটক হয়নি। মামলার পর প্রাণভয়ে এলাকাছাড়া হয়েছিলেন অনিক আর চক্রের প্রধান জামাল বুক ফুলিয়ে শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছে।

এ বিষয়ে কেশবপুরের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের একটি মামলার বাদী মিজানুর রহমান শিমুল বলেন, তার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়া হয়। এরমধ্যে ৩০ হাজার টাকা নেয় জামাল গং। এছাড়াও তার কাছ থেকে মোটরাইকেল, ব্যাংক চেক ও স্টাম্পে সই করিয়ে নেয়। পরে মেয়র সহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। এরপর থেকে তিনি কেশবপুর ছাড়া।

কেশবপুর উপজেলার ডিস ব্যবসায়ি খন্দকার মফিদুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে মামলা করে তিনি এলাকা ছাড়া। তিনি জীবন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আরেক ভুক্তভোগি যুগান্তর পত্রিকার কেশবপুর উপজেলা প্রতিনিধি ও উপজেলা নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান বলেন, আমরা যেখানে নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করছি, সমাজের বিভিন্ন অন্যায় নিয়ে কাজ করছি সেখানে আমাদের উপর হামলা চালানো হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের সময় এ ধরনের আচরণ আমরা প্রত্যাশা করিনা।

প্রসঙ্গত, গত ১ বছরের মধ্যে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ জামাল বাহিনীর তান্ডবের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে পৌর শহরের সাহাপাড়া এলাকার কার্তিক সাহার ছেলে প্রান্ত সাহা, সাবদিয়া গ্রামের বাবুল গাজীর ছেলে টিপু সুলতান, একই গ্রামের শামসুর রহমানের ছেলে আলতাপ হোসেন, বাগদা গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে মামুন, একই গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল কাদেরের ছেলে এখলাসুর রহমান কনক, আলতাপোল গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে মোহাম্মদ আবুল হাসান ও একই গ্রামের শেখ আজ্জাত আলীর ছেলে ঠিকাদার শেখ দেলোয়ারকে অপহরণ করে মারপিট করার পর প্রত্যেকের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয় তারা। প্রাণভয়ে কেউ থানায় অভিযোগ করেনি। পৌর এলাকায় প্রতিদিন কেউ না কেউ এভাবে তাদের হামলার শিকার হচ্ছেন। নতুন ভবন তৈরি করতে, দোকান উদ্বোধনে, জায়গা-জমি ক্রয় করলে, অবৈধভাবে জায়গা দখল করতে, কেউ নতুন ব্যবসায় নামলে, বিদেশ ফেরত প্রবাসী আসলে অথবা ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উপঢৌকনের নামে চাঁদা আদায় করছে। তাদের দাবি পূরণ না হলে হামলা, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হতে হচ্ছে। তবে পুলিশ দাবি করছে, অভিযোগ না দেওয়ায় তারা এদের বিরুদ্ধে এতদিন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী মিলন মিত্র বলেন, অপরাধীরা অপরাধ একবার করার পর যদি তাদের শাস্তি না হয় দিনদিন এ অপরাধীরা আরো বেশি অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

এ বিষয়ে কেশবপুর উপজেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, কেশবপুরে হঠাৎ ভয়াভয় রুপ ধারণ করেছে কিশোর গ্যাং। এখনই এর লাগাম টানার দরকার। অন্যথায় কেশবপুরের যুব সমাজ ধংস হয়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। একই সাথে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

কেশবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ বোরহান উদ্দীন বলেন, তারা সন্ত্রাসরোধে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। আবু তাহের নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় জামালসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আসামি আটকে পুলিশি অভিযান অব্যহত রয়েছে।

নয়া শতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ