জীবন-যুদ্ধ করে শখের হাঁড়ি বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্রী সুশান্ত কুমার পাল। বিলুপ্তির পথে দেশের লোকজ কারুশিল্প। উৎপত্তিস্থল রাজশাহী অঞ্চলের কোথাও আর শখের হাঁড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু জীবনে অনেক সংগ্রাম করে আজও শখের হাঁড়ি টিকিয়ে রেখেছেন মুল কারিগর সুশান্ত কুমার পাল। এটাই তার পেশা।
রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে সুশান্ত কুমার পালের বাড়িতে এখনো জমকালোভাবে তৈরি হয় শখের হাঁড়ি। লাভ-লোকসানের তৈয়াক্কা করেন না। স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিকেও বাদ রাখেননি এই পেশা থেকে। পরিবারের ১৭ জন সদস্য এখনও শখের হাঁড়ি তৈরির কাজে লিপ্ত রয়েছেন। বুধবার সরে জমিনে সুশান্ত কুমার পালের বাসায় গিয়ে শখের হাঁড়ি তৈরির গল্প ও ইতিহাস জানা গেছে। নয়া শতাব্দীর কাছে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন তিনি।
শখের হাঁড়ি তৈরির কারিগর সুশান্ত কুমার পাল বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের বাসিন্দাদের ঘর সাজানোর শৌখিন সামগ্রী সংরক্ষণ এবং উৎসবে বিশেষ ধরনের শখের হাঁড়ি তৈরি করা হতো। কৃষিপ্রধান ওই অঞ্চলের বড় বড় হাটে বিভিন্ন ধরনের শৈল্পিক কারুকার্যমণ্ডিত শখের হাঁড়ি বিক্রি হতো। রাজশাহী অঞ্চলের সাড়ে চার হাজার পরিবার এ হাঁড়ি তৈরির কাজ করতেন। আমার জন্ম এই রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার বাগধানীর বসন্তপুর গ্রামে। আমার বাবাসহ সবাই এই পেশার সাথে জড়িত ছিলো। শিশুকালে কর্মটি শেখা আমার দাদুর কাছ থেকে। দাদুর নাম বর্নাশ্বর পাল। সেই থেকে আজও হাল ছেড়ে দেয়নি। ব্রিটিশ আমলে দাদু শখের হাঁড়ি তৈরি করে ১০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমি জীবন-যুদ্ধ করে শখের হাঁড়িটি বাঁচিয়ে রেখেছি। আজও টিকে আছি, এখনও শখের হাড়ি টিকিয়ে রেখেছি। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুন্ত হচ্ছে। কিন্তু এখন এমন হয়ে গেছে, ব্যবসায়িতে ভরে গেছে। মুল শিল্পীরা স্থান পাচ্ছে না। ব্যবসায়িদের বেশি জায়গা দেওয়া হচ্ছে, মুল শিল্পীদের এক কর্ণারে স্থান দেওয়া হচ্ছে। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সকলের দায়িত্ব রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলের প্রাচীণ ঐতিহ্য শখের হাঁড়ি। এক সময় এই অঞ্চলে পাকা বাড়ি ছিলো না। মাটি ও খড় দিয়ে বাড়ি বানানো হতো। সেই বাড়িতে সিকায় করে শখের হাঁড়ি ঝুলানো হতো। শখের হাঁড়িতে বাসার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র টাঙানো থাকতো। এছাড়া বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে পিঠাপুলি ও পানের সাজনসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র শখের হাঁড়িতে করে দিতেন। এখন আর কেউ নেয় না শখের হাঁড়ি। কী আর বলবো শখের হাঁড়ি এমন পার্যায়ে গেছে, আমি মানুষের কাছ থেকে সুদের উপর টাকা নিয়ে ঢাকায় মেলা করতে গিয়েছিলাম, পরে জমি-ভিটা বিক্রি করে সেই টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। তবুও আমি পেশাকে ছেড়ে দিতে পারিনি। আজও ধরে আছি। আমার দুই ছেলে সঞ্জয় কুমার পাল ও মৃত্যুঞ্জয় কুমার পাল, মেয়ে, নাতি-নাতনিও ধরে আছে এই পেশা। শখের হাঁড়ি তৈরি করছে।
তিনি বলেন, প্রজন্মটি টিকে থাকবে কিনা জানি না। গোটা রাজশাহী বিভাগ ঘুরে দেখেন, কোথায় শখের হাড়ি পাবেন না। আর আগের শিল্পীগুলো নেই। কেউ আর কাজ করে না। বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদি কেউ করে থাকে আমার দেখাদেখি প্রভাব বা নামে হতে পারে। আগের কোনো শিল্পী নেই। এখন যারা তৈরি করে তাদের তৈরি শখের হাঁড়িতে সেই প্রাকৃতিক রং হবে না। তারা এখন অ্যালামিন প্রিন্ট দিয়ে কাজ করবে। প্রাকৃতিকভাবে শখের হাড়ি তৈরি করতে পারবে না। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সকলের দায়িত্ব রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির বই পুস্তকেও আমার ছবিসহ শখের হাঁড়ি তৈরির কথা বলা রয়েছে। আমি ১৭টি দক্ষ পুরষ্কার, ৪টি শ্রেষ্ট পুরস্কার এবং ১টি রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছি। তিনি দাবি করেন, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন স্কুলে শিশুদের এ ধরণের শিল্পকে উপহার দেওয়া যেতে পারে। যেমন ঢাকার হাটকো নামে একটি স্কুল আমার কাছ থেকে বৈশাখে শখের হাঁড়ি কিনে নিয়ে বাচ্চাদের উপহার দেন। তারা উৎসাহী হয়। এভাবে আমরা যদি বিভিন্ন স্কুলে এই শিল্পকে পরিচিত করাতে পারি, তাহলে হয়তো এই শিল্পকর্মটি টিকে থাকতে পারে। একসময় বিদেশ থেকে নৌকা নিয়ে শখের হাঁড়ি কিনতে বাইরের লোক আসতো এবং প্রচুর হাঁড়ি কিনে নিয়ে যেতো। আমার জীবনে একবার এ ধরনেরর হাঁড়ি বিক্রি করার সৌভাগ্য হয়েছিল। কালের বিবর্তনে শখের হাঁড়ি বিক্রি কমে গেছে। লোকজন এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। হাঁড়ি বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, এক সময় গ্রামীণ বাংলার গৃহিণীদের ঘর সাজানোর অন্যতম সম্বল ছিল শখের হাঁড়ি। নানা রঙে ও নকশায় তৈরি মাটির সেই হাঁড়ির প্রচলন বলতে গেলে উঠেই গেছে। তবে শখের এই হাঁড়িকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে গত বছরের মার্চে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) কাছে আবেদন করেছেন বাংলা একাডেমি। শুধু এ হাঁড়ি নয়, আরও দুটি ঐতিহ্যকে দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের বিখ্যাত খেজুরের রস, অন্যটি বাংলা সাহিত্যের সম্পদ চর্যাগীতি স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশ থেকে আবেদন করা হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ