চুয়াডাঙ্গায় স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও বেশিরভাগ বসতবাড়ি ও দোকানের টিনের চাল ফুটো হতে দেখা গেছে। উঠতি ফসলের এমন ক্ষয়-ক্ষতিতে দিশাহারা কৃষক। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। ফসলের সাথে আবহাওয়ার এমন বৈরি আচরণে লোকসানের মুখে চাষীরা। একদিকে লোকসান, অন্যদিকে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা, সবমিলিয়ে ফালগুনের এ সময়টা মোটেও ভালো কাটছে না কৃষকদের। এ ক্ষতি কখনো পুষানো যাবে না।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, ঋণ নিয়ে বিঘা বিঘা জমিতে তারা ভুট্টা, গম, তামাক, মসুর, কুল, তরমুজ, পানসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি আবাদ করেছিলেন। কিন্তু শিলাবৃষ্টি আর ঝড়ে খেতের সব ভুট্টাগাছ ভেঙে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জমিতে নতুন করে ভুট্টা চাষের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়াও আম মুকুলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
অপরদিকে জমি চাষ, ফসল কাটা, পরিবহন, মাড়াই, ঝাড়াই ও সেচের জন্য ডিজেলচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে খরচ বৃদ্ধির ফলে ফসল উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এনজিও থেকে ঋণের কিস্তি এবং লোকজনের কাছ থেকে নেয়া টাকা পরিশোধ করাই এখন ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ তাদের ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
চুয়াডাঙ্গায় আবহাওয়া ও কৃষি অধিদপ্তর বলছে, চুয়াডাঙ্গাবাসী এর আগে এমন শিলাবৃষ্টি দেখেনি। কৃষকদের ফসলের এমন ক্ষয়ক্ষতি আগে কখনো হয়নি।
চুয়াডাঙ্গায় কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ছয় ইউনিয়ন ও দামুড়হুদা উপজেলার আংশিক দুটি ইউনিয়নে হাজার হাজার কৃষকের প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ৪৯৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এতে ১০৮ কোটি টাকার বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইউনিয়নগুলো হলো, সদর উপজেলার আলুকদিয়া, মোমিনপুর, শংকরচন্দ্র, কুতুবপুর, গড়াইটুপি ও পদ্মবিলা। দামুড়হুদা উপজেলার নতিপোতা ও জুড়ানপুর ইউনিয়নের আংশিক কিছু। যার মধ্যে এ জেলায় ভুট্টা আবাদ হয়েছে ৪৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। আর শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ১৩ হাজার ২৫৩ হেক্টর জমির ফসল। গম ৯৯৫ হেক্টরের মধ্যে ক্ষতি হয়েছে ৫৫ হেক্টর, বোরো ধান ৩৬ হাজার ৮৭৯ হেক্টরের মধ্যে ১ হাজার ৪৭০ হেক্টর, কলা ১ হাজার ৫২৬ হেক্টরের মধ্যে ১৫৩ হেক্টর, পেঁপে ৫২০ হেক্টরের মধ্যে ৯৫ হেক্টর, পেঁয়াজ ১ হাজার ৬১৫ হেক্টরের মধ্যে ৩৫ হেক্টর, মসুর ৯১৭ হেক্টরের মধ্যে ২৩৪ হেক্টর, রসুন ২৬৬ হেক্টরের মধ্যে ২০ হেক্টর জমির ফসলে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। তাছাড়া পানবরজ ১ হাজার ৬২২ হেক্টরের মধ্যে ২৭৫ হেক্টর, তরমুজ ১১০ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৫ হেক্টর, আম ২ হাজার ৪২৯ হেক্টর জমির মধ্যে ৪৩০ হেক্টর, পেয়ারা ১ হাজার ৭৪১ হেক্টর জমির মধ্যে ১৮৫ হেক্টর, লিচু ২৫৫ হেক্টর জমির মধ্যে ২০ হেক্টর, তামাক ৩২৭ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৩ হেক্টর, ধনেপাতা ১৯০ হেক্টর জমির মধ্যে ৪০ হেক্টর ও শাকসবজি ৮ হাজার ৩৪২ হেক্টর জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮০ হেক্টর জমি।
এছাড়াও কুল বা বরই, টমেটোসহ সবধরণের সবজির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। সব থেকে ধান ক্ষতিগ্রস্ত কম হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সাতগাড়ি গ্রামের নতুন উদ্যোক্তা শিমুল হাসান পলক বলেন, চাকরি ছেড়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ১০ বিঘা জমিতে কুল, মাল্টা, ড্রাগন ও পেয়ারা চাষ করেছিলাম। এই ঝড়- শিলা বৃষ্টিতে ১০০ মনের বেশি কুল পড়ে গেছে। গাছে যে কুলগুলো আছে সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও ২০০ মন পেয়ারা শিল পড়ে নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি ড্রাগন ও মাল্টা গাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিগ্রস্ত কখনো পুষাবেনা। নষ্ট হওয়া ফসল কেউ নিতেও চাচ্ছেনা। এখন কোথায় থেকে এই ঋণের টাকা শোধ করবো? সরকারের অনুদান পেলে হইতো আমরা ঘুরে দাড়াতে পারবো বলেন জানায় এই উদ্যোক্তা।
কুলচারা গ্রামের কৃষক হুমায়ুন কবির বলেন, ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে আমার পাঁচ বিঘা জমির ভুট্টা সব শেষ হয়ে গেছে। একটি গাছ ও ভালো নেই। সেগুলো রান্নার কাজে ব্যবহৃত ছাড়া কোন উপাই নেই। এছাড়াও বরজের পানও সব নষ্ট হয়ে গেছে। ধারকর্জ করে ফসল ফলিয়েছিলাম। এখন পথে বসা ছাড়া কোনো উপাই দেখছিনা।
পৌর এলাকার তালতলা ও হাজরাহাটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এই গ্রামে বেশিরভাগ পান চাষি। এই দুটি গ্রামে ৬শ’ থেকে ৭শ’ পান বরজই আছে। ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে সব পান বরজ নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় কৃষকরা হতাশায় পড়ে গেছেন। কারোর বাড়ির টিন ছিদ্র হয়েছে। কোন রকম পলিথিন দিয়ে রেখেছেন তারা। একদিকে ফসলের ক্ষতি অপরদিকে বাড়ির টিন ফুটো। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।
গ্রামবাসিরা বলছেন, হঠাৎ ঝড় শিলাবৃষ্টির কারণেবাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। এই গ্রাম দুটিতে পান বরজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও মৌসুম ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি সাহায্য ছাড়া কখনো উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হবেনা তাদের। এর আগে কখনো এমন ক্ষয়ক্ষতি দেখেনি আমরা।
তালতলা গ্রামের জামাল হোসেন বলেন, আমি খুবই দরিদ্র। আমার কোন ছেলে নেই। দুটি মেয়ে আছে৷ লোকের কাছে ধারদিনা করে পান বরজটা দাড় করেছিলাম। ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে সব শেষ হয়ে গেছে৷ আবার ঘরের টিন অনেকস্থানে ফুটো হয়ে গেছে৷ এখন কিভাবে ধারদিনে শোধ করবো? সরকারের অনুদান পেলে আমরা চলতে পারব। এছাড়া এখন চলার কোন উপায় নেই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
অপর পানচাষী বলেন, এই গ্রামে ৬শ পানচাষি আছে। এমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখান থেকে উঠার মত শক্তি আমাদের নেই। এখন এক কেজি চাউল কিনবো সেই পরিস্থিতিও নেই আমাদের। এখন পান বিক্রির সময়। আমরা কেউ এখনো বিক্রি করতে পারিনি। এই পান বিক্রি করে সবাই ধারদেনা পরিশোধ করবেন। ঠিক এ সময়ে ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এখন সরকার আমাদের পাশে না দাড়ালে বিষ খেয়ে মরা ছাড়া কোন বুদ্ধি নেই।
আলুকদিয়া গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, সাত বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছিলাম। আর এক বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করলাম। আজ ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে সব ভুট্টাগাছ ভেঙে শেষ হয়ে গেছে। তরমুজ ফুটো হয়ে গেছে। এছাড়াও বাগানের সব গাছের আমের মুকুল পড়ে গেছে। আমি এখন কী খাব। পরিবারকে নিয়ে পথে নামতে হবে বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসার তালহা জুবায়ের মাসরুর বলেন, ‘শিলাবৃষ্টির পর আমি ফসলের মাঠ পরিদর্শন করছি। সদর উপজেলায় ছয় ইউনিয়নের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সব থেকে ভুট্টা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও তরমুজ, কুল, আমের মুকুলে ক্ষতি হয়েছে। তবে ধানের ক্ষতি তুলনামূলক কম। এমন ক্ষয়ক্ষতি আগে কখনো দেখেনি আমরা। আমরা অনুমান করছি সদরের ছয় ইউনিয়নে ১০০ কোটি টাকার বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, এই উপজেলায় জুড়ানপুর ও নতিপোতা ইউনিয়নের আংশিক কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। যা ৮ কোটি ২০ লাখ ২৭ হাজার ৫০ টাকার। সব থেকে ভুট্টা ও তামাক নষ্ট হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আব্দুল মাজেদ বলেন, মাত্র ১০-১৫ মিনিটের ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে ফসলের এমন ক্ষতি আগে কখনো দেখেনি চুয়াডাঙ্গাবাসি। দেশের মধ্যে ভুট্টা চাষের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে চুয়াডাঙ্গায়। তাই এখানে যে পরিমান ভূট্টারক্ষতি হয়েছে তা কখনো পুষাবার নয়। এছাড়াও অনেকস্থানে বসত বাড়ির টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা আনুমান করছি জেলায় ১০৮ কোটি টাকার বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক সপ্তাহ লেগে যাবে পূর্নাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির পরিমান জানতে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বাড়তে পারে। আমি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহযোগিতার বিষয়টি জানিয়েছি।
উল্লেখ্য, রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) চুয়াডাঙ্গায় স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি হয়েছে। বেলা ৩টা ১০ মিনিট থেকে ৪টা পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি হয়। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বড় বড় বরফের টুকরা পড়তে থাকে। টানা প্রায় ১৮ মিনিট ধরে শিলাবৃষ্টিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অনেকে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সামাদুল হক জানান, এমন শিলাবৃষ্টি চুয়াডাঙ্গাবাসী আগে কখনো দেখেনি। বেলা ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ১৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় ৪০ কি.মি. বাতাসের বেগ ছিল। শিলার পরিমাণ ছিল ১ ইঞ্চি।
নয়া শতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ