ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মাতৃত্ব হারাচ্ছেন নারীরা

পুরুষ ও শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে চর্মরোগে

লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের নারীরা হারাচ্ছেন সন্তান ধারণ ক্ষমতা। কেটে ফেলতে হচ্ছে জরায়ু। এর ফলে অল্প বয়সী অনেক নারীর ভাগ্যেই নেমে আসছে তালাক! চিরতরে সন্তান ধারণে অক্ষম হওয়ায় স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার দুর্ভাগ্য মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ব্যবহার করে পুরুষ ও শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছেন জটিল ধরনের চর্মরোগে। সম্প্রতি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা সরেজমিন ঘুরে মিলেছে এমন তথ্য।

জানতে চাইলে গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ২০০৯ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে দ্বীপ ইউনিয়নটি লোনাপানির কবলে পড়ে। তারপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা-জলোচ্ছ্বাস লেগেই আছে। বর্ষা মৌসুমে সামান্য সময়ের জন্য একটু বৃষ্টি পানির দেখা মিললেও বাকি সময়টা কাটাতে হয় লোনাপানিতে। এ কারণে গাবুরার মানুষরা বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা রয়েছে ঝুঁকিতে।

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও অজয় কুমার সাহা জানান, ‘প্রায় প্রতিদিনই নারীরা তাদের নানা ধরনের চর্মরোগ নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। অনেকের অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলা লাগছে। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে।’

৭ বছর আগে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার. গ্রামের চকবারা মনিরা খাতুন বিয়ে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী দৃষ্টিনন্দন গ্রামে। স্বামীর সংসারে দৈন্যের কারণে পার্শ্ববর্তী খোলপেটুয়া নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরতেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যে মনিরা নিজের শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। শারীরিক অবস্থা অস্থিতিশীল বুঝতে পেরে দ্রুত চলে যান পার্শ্ববর্তী ডুমুরিয়া গ্রামে অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিকে। সেখানে দায়িত্বরত ইউনিয়ন হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার হেলেনা বিলকিস প্রাথমিক চিকিৎসা দেন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে জরায়ু অপারেশনের কথা বলেন এবং এক পর্যায়ে অপারেশন করিয়ে নেন।

ইউনিয়ন হেলথ প্রোভাইডার হেলেনা বিলকিস নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন জরাজীর্ণ এই স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র থেকে ইউনিয়নের হতদরিদ্র মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চর্মরোগ জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে যার অধিকাংশ নারী ও শিশু। লবণাক্ত পানির কারণে এর সমস্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

গাবুরা চৌদ্দরশি গ্রামের ৮ বছর বয়সি ফয়সাল আহাম্মেদ। পানির কারণে তার চোখ সব সময় লাল হয়েই থাকে। রোদের দিকে তাকাতে পারে না শিশুটি। এ কারণে ফয়সাল অন্ধকারে থাকতে ভালোবাসে।

গাবুরা হরিশখালী গ্রামের বিধবা তাহমিনা জানান, তার জরায়ু অপারেশন করা হয়েছে আরো আগে। বর্তমানে তার পুরো পরিবারের সদস্যরা ভুগছেন বিভিন্ন চর্মরোগে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌ-খালি গ্রামের শাহানারা, শাহিদা, ফিরোজা,ফাতেমা ও মোমেনারও জরায়ু নাড়ি কেটে ফেলা হয়েছে।

স্থানীয় কয়েক নারী নামপ্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জরায়ু কেটে ফেলার কারণে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তাদের। অপারেশনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার কারণে এখন আর আমাদের বিয়ে করতে কেউ রাজি হচ্ছে না। এ কারণে বাধ্য হয়ে বাপের বাড়িতেই বসবাস করতে হচ্ছে তাদের।

স্থানীয় মডার্ন ক্লিনিকের স্বত্বাধিকারী তপন কুমার জানান, উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরের প্রতিটি গ্রামে জরায়ুসংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে। উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন উপজেলা সদরে চর্ম যৌন এলার্জি রোগের চিকিৎসা নেয়ার জন্য শত শত মানুষ আসেন উপজেলায়। অনেকেই আবার দু’তিনবার দেখানোর পর এর কাজ না হলে ছুটে যান সাতক্ষীরা অথবা খুলনায়। আবার অনেকে ঢাকায়ও চিকিৎসা নেন।

ডা. তপন কুমার জানান, লোনাপানির পিপিডি বেড়ে যাওয়ার কারণে এ ধরনের রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের রোগ থেকে বাঁচার জন্য সুপেয় পানি ব্যবহারের তাগিদ দেন তিনি।

জানা গেছে, খোলপেটুয়া নদীর তীরে অবস্থিত মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়ন। খোলপেটুয়া নদী ও সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল এই এলাকার অধিবাসীরা। ইউনিয়নটির মৌখালী গ্রামে পানিবাহিত রোগে ভুগছেন এমন কিছু মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী লোনাপানি ব্যবহারের কারণে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে নারীদের অনিয়মিত মাসিকসহ সন্তান ধারণক্ষমতা হারাচ্ছে অনেকেই।

মুন্সীগঞ্জ ময়না হোটেলের স্বত্বাধিকারী আলেয়া বলেন, অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় স্বামীর পাশাপাশি তিনিও নদীতে নেট জাল টেনে রেণু পোনা আহরণ করতেন। দীর্ঘদিন পরে তিনি তার শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগ চুলকানি ও এলার্জি জাতীয় সমস্যা দেখা দেয়। পরে তিনি বুঝতে পারেন তার মাসিকে সমস্যা হচ্ছে। বুঝতে পেরে শ্যামনগরে অবস্থিত স্থানীয় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যোগাযোগ করেন। ডাক্তার দেখিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে তাকে জানানো হয়— তার জরায়ুতে ইনফেকশন হয়েছে এবং সেটি খুব মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। মনের মধ্যে ভয় নিয়ে সুদে টাকা নিয়ে অপারেশন করেন তিনি। গুনতে হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। অপারেশনের পর থেকে নদীতে মাছ ধরার সক্ষমতা হারান তিনি।

কদমতলা গ্রামের কুলসুমা বেগম বিয়ে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী গ্রামে। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে ফিরে আসেন বাবার বাড়ি। শুরু হয় জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ। জীবন বাঁচাতে লোনাপানিকে আঁকড়ে ধরেন তিনি। পার্শ্ববর্তী চুনকুড়ি নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরা ছিল তার জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস। একদিন নদীর ভেতরেই পেট ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন কুলসুমা বেগম। পরে নদীতে মাছ ধরা অন্য মানুষের সহযোগিতায় বাড়িতে আনা হয় তাকে। গরিব মানুষ হওয়ায় ভালো ডাক্তার না দেখাতে পেরে চলে যান মুন্সীগঞ্জ বাজারে অবস্থিত আর জি ক্লিনিকে। সেখানে গ্রাম্য ডাক্তার নিহার রঞ্জনের পরামর্শ নেন তিনি। আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে জরায়ুতে সমস্যা ধরা পড়ার পর অপারেশন করে কেটে ফেলা হয় জরায়ু নাড়ি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লোনাপানিপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে পদ্মপুকুর, গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ, আটুলিয়া, কাশিমাড়ী, রমজাননগর ও কৈখালীতে লবণাক্ত পানির পরিমাণ বেশি থাকায় এই রোগগুলো বেশি লক্ষ্য করা যায়।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ