রাজশাহী নগরীর গ্রেটার রোডের বহরমপুর বাইপাস মোড়ে চোখ মেললেও দেখা পাওয়া যায় নান্দনিক কারুকাজ খচিত বেতের আসবাবপত্র। রোডের ধারে দোকানো ঝুলানো রয়েছে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন ধরণের ঘর সাঁজানো সরঞ্জাম বেতের কারুকাজ। সৌখিন মানুষের প্রিয় জিনিস এগুলো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় অত্যাধুনিক প্লাস্টিক, ম্যালামাইন, কাঠসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার দখল ও রমরমা বাণিজ্যের কারণে ক্রেতা সংকটে পড়েছে এই ঐহিত্যবাহী কারুশিল্প। টেকসই, সহজে বহনযোগ্য, নান্দনিক কারুকাজের বেতের মাধ্যমে শিশুদের দোলনা, মোড়া, বেড, সোফাসেট, চেয়ার, আলনা, ফুলের টপসহ সকল ধরণের জিনিস তৈরি করা যায়। একসময় প্রচুর চাহিদা ছিলো বেতের আসবাবপত্রের। রাজশাহীতে তৈরি এই কারুশিল্প বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা গেছে। কিন্তু এখন আর সেই ক্রেতা সমাগম নেই। রাজশাহী থেকে আর বাইরেও পাঠানো হচ্ছে না বেতের আসবাপত্র। ক্রেতারা যদি বেতের জিনিস ক্রয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তাহলে দিনে দিনে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পও দেশ থেকে হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
মজুরি বৃদ্ধি ও স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বেত আমদানি করতে হয়। তাই বেতের জিনিসপত্রের দাম আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু আগ্রহ তেমন বাড়েনি। ফলে ক্রমেই ক্রেতা সংকটের মুখে পড়ছে এই শিল্প।
সরেজমিনে রাজশাহী নগরীর গ্রেটার রোডের বহরমপুর বাইপাস মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি বেতের দোকানো শ্রমিকরা কাজ করছেন। কর্মচারি মিলন আলী বলেন, ব্যবসা মুদ্রা। ক্রেতা নেই। বেতের দাম প্রসঙ্গে তারা বলেন, প্রতি কেজি চিকন বেতের দাম ৮’শ থেকে ১২’শ টাকা। ১২-১৬ ফিট সাইজের প্রতি পিস বেতের দাম পড়ে ১৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। বেতের তৈরি ঘরের সোফাসেট বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। শিশুদের দোলনার দাম ১ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। হেলান দেয়া দুলুনি চেয়ার, মোড়া বিক্রি হয় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। খাটের দাম ১৬ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া ফুলের ঝুড়ি, ড্রেসিং টেবিল, আলনাসহ বেতের তৈরি ঘরের সবধরণের জিনিসপত্র সাজানো রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, একসময় রাজশাহী নগরীর হোসনিগঞ্জ বেতপট্টিতে রাস্তার দু’পাশে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৪টি দোকান ছিল। এখন সেখানে ২-৩টি ছাড়া কোনো দোকান নেই। তবে গ্রেটার রোডের নতুন বিলসিমলা বাইপাসে এখন ৫-৬টি দোকান রয়েছে। তবে দোকানগুলোতে বেতের তৈরি কিছু কিছু জিনিপত্র পাওয়া গেলেও তুলনায় কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেতের তৈরি জিনিসের চাহিদা কমায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।রাজশাহীতে গ্রেটার রোডে ২১ বছর থেকে বেত শিল্পের ব্যবসায়ী আহম্মেদ আলী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘১৯৮৩ সালে স্থায়ী নিবাস ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে চলে আসি। এখানে এসে বেত শিল্পের ব্যবসা শুরু করি। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর অস্ট্রেলিয়াতে বেতের তৈরি জিনিসপত্র রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অর্থনীতিতে যোগ করেছি। এই শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির জন্যই মুলত চেষ্টা করছি। কিন্তু রাজশাহীর লোকজন এই কাজে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বর্তমানে ৮ জন কর্মচারি আমার দোকানে কাজ করেন। তাদেরকে দিনে ৫’শ থেকে ৮’শ টাকা পর্যন্ত মজুরি দিতে হয়। আগে ব্যবসা ভালো হতো। এখন ব্যবসা নেই। ক্রেতারা প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ব্রান্ডের পণ্যের বাজারে বেশি ভিড় করছেন। বেতের তৈরি জিনিসের দাম কম, টেকসই, সহজে বহনযোগ্য হলেও তারা বেশিদামে ক্রয় করতে অনীহা দেখাচ্ছে। তাই আগ্রহ হারালে দিন দিন এই শিল্প অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। তবে তিনি এখন রাজশাহী জেলাখানায় বন্দী কয়েদীদের মাঝে বেতশিল্পের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
বেতশিল্পের কারিগর আব্দুর রাজ্জাক জানান, সবচেয়ে বেশী বেত উৎপন্ন হয় ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়ায় উৎপন্ন বেতের গুণগতমানও সবচেয়ে উন্নত। এছাড়া ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মায়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডেও বেত জন্মায়। রাজশাহীতে মিয়ানমার (বার্মা), ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে বেত আনা হয় এখন। ইন্দোনেশিয়ার বেতের দাম সবচেয়ে বেশি। মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিটি বেতের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা। এছাড়া দেশি বেত মোটা ১০০ টাকা ও পাতলা (ফালি বেত) ২৫ থেকে ৫০ টাকা। ভারতীয় বেত কিনতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার বেত ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায়।তিনি বলেন, ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়লে এই শিল্পের চাহিদাও বাড়বে। আগে বেতের তৈরি জিনিসপত্রের একক বাজার দখল ছিলো। এখন মজুরি বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বেতের জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতা সেই হারে বাড়েনি। তাই সৌখিন ক্রেতারা বেত শিল্প ধরে রাখলে এই শিল্প কখনো বিলুপ্ত হবে না বলে জানান তিনি।
রাজশাহী নগরীর প্রবীণ ব্যক্তিত্ব চিত্রশিল্পী ও ছড়াকার এম এ কাইউম নয়া শতাব্দীকে বলেন, অতীতে টোলে গুরুমুখী বিদ্যার পর বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের হাতে প্রথম বেতের সাথে পরিচিত হয় শিশু শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে পরিচিত হয় বেত শিল্প হিসেবে। একসময়ে রাজশাহীর অনাচে-কানাচে পাওয়া যেত লাটা-কাঁটার সাথে ঝোপ ধরে থাকা বেত। ঝুড়ি, ঝাঁকা, ধামা, চ্যাঙ্গারি, কুলা, কাঠা, চালুন ইত্যাদি এই বেতের মাধ্যমে তৈরি করে এক শ্রেণির মানুষ জীবিকা অর্জন করতো। কেউ কেউ বেতের ফল বিক্রি করেও সংসার চালাতো। অতীতে রাজশাহীর পবা উপজেলায় গাঢ় অন্ধকার বেতের ঝোপ-ঝাড় থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা টমটম বা ঘোড়ার গাড়িতে করে দিনে দিনে সংগ্রহ করতো এসব বেত ও বেতের ফল। কারণ বেতের ঘন ঝোপ-ঝাড়ে বসবাস করতো ভয়ংকর সব হিংস প্রাণী। বর্তমানে নগরায়ণের ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে বেতের সেই আবাস। এখন শিশুরাও আর বিদ্যালয়ের সামনে কখনো বসে থাকতে দেখে না থোকা থোকা বেত ফল বিক্রেতাদের। প্লাস্টিক আমদানির ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতির সেই সমস্ত বেতের তৈরি ধামা-কুলা, কাঠা আর তৈরি করে না শ্রমজীবি মানুষ। ফলে ক্রমেই রাজশাহীতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বেতের তৈরি ওই সমস্ত তৈজসপত্র।
এমনকি ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের কোনো তথ্য নেই রাজশাহী কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা উম্মে ছালমা নয়া শতাব্দীকে বলেন, বহু প্রাচীণ ঐতিহ্য বেত। বেতের মাধ্যমে অনেক সৌখিন আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। কিন্তু আমাদের কাছে এই বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ