ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বারবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেলেও অবহেলায় পড়ে আছে ‘বাসুদেব মন্দির’

প্রকাশনার সময়: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২:৪৭ | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২:৫৫

কৃষ্ণ বা শ্রীকৃষ্ণ হলেন হিন্দু ধর্মানুসারীদের আরাধ্য ভগবান। তিনি ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার রূপে খ্যাত। কখনো কখনো তাকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর (পরম সত্ত্বা) উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ যার আরেক নাম বাসুদেব। হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে সাহিত্যে, গল্প, আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে। এছাড়া শ্রী কৃষ্ণের ‘শাসন ব্যবস্থা কূটনৈতিক যুদ্ধ কৌশল বা রণনীতি’ বিভিন্ন রূপকথার প্রচলন আছে।

অথচ অযত্ন আর অবহেলায় ফরিদপুরের ৫০০ বছরের পুরানো ঐতিহাসিক স্থাপনা বাসুদেব মন্দির। অবহেলা অনাদর ও সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে মন্দিরটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

শ্রীকৃষ্ণ: শাস্ত্রীয় বিবরণ ও জ্যোতিষ গণনার ভিত্তিতে লোকবিশ্বাস অনুযায়ী কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল ৩২২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১ জুলাই বুধবার। কৃষ্ণের জন্মদিনটি কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী বা জন্মাষ্টমী নামে পালিত হয়।

শ্রীকৃষ্ণ যাদব-রাজধানী মথুরার রাজ পরিবারের সন্তান। তিনি বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম পুত্র। একটি দৈববাণীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে তার মৃত্যু হবে। এই কথা শুনে তিনি দেবকী ও বসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাদের প্রথম ছয় পুত্রকে হত্যা করেন। দেবকী তার সপ্তম গর্ভ রোহিণীকে প্রদান করলে, বলরামের জন্ম হয়। এরপরই কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন।

কৃষ্ণের জীবন বিপন্ন জেনে জন্মরাত্রেই দৈবসহায়তায় কারাগার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বসুদেব তাকে গোকুলে তার পালক মাতাপিতা যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। কৃষ্ণ ছাড়া বসুদেবের আরো দুই সন্তানের প্রাণরক্ষা হয়েছিল। প্রথমজন বলরাম (যিনি বসুদেবের প্রথমা স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন) এবং সুভদ্রা (বসুদেব ও রোহিণীর কন্যা, যিনি বলরাম ও কৃষ্ণের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেন)। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, কোনো প্রকার যৌনসংগম ব্যতিরেকেই কেবলমাত্র ‘মানসিক যোগের’ ফলে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, সেযুগে এই ধরনের যোগ সম্ভব ছিলো।

পরবর্তীতে তিনি রাজা হন এবং সাগরের মাঝে দ্বারকা নামে এক বিশাল শহর তৈরি করেন।

প্রসঙ্গত, আনন্দনাথ রায় রচিত ফরিদপুর ইতিহাসে পাওয়া যায় এই বাসুদেব মন্দিরের কথা। মূলত এই বইয়ে বাসুদেব মন্দির ভাঙ্গা উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের মুকডোবা এলাকায় প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ্য করা হয়েছে। তবে নদী ভাঙন এর কারনে মন্দির টা যখন বিলীন হয়ে যেতে থাকে তখন খাটরার সরকারেরা প্রাণপুর মৌজায় বাসুদেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরে ৭৫ এর পরবর্তীতে আরো উত্তরে প্রাণপুর মৌজায় বাসুদেব মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।

এখনো অনলাইনে ভাংগা উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নাম দেখতে চাইলে খাটরা বাসুদেব মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। পূর্বের স্থানে (খাটরা) এখনো রথ টানার পাকা রাস্তা ছোট কিছু স্থাপনা ও জমি রয়েছে।

স্বাধীনতার আগে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার কাউলিবেড়া ইউনিয়নের খাটরা এলাকায় বাসুদেব মন্দিরটির স্থাপনা থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৫ সালের দিকে সেটি স্থান্তরিত করে পাশ্ববর্তী প্রাণপুর গ্রামে পুনঃস্থাপন করা হয়।

ঐতিহ্যবাহী বাসুদেব মন্দির বাঁচাতে প্রাণপুরের ভট্টাচার্য পরিবারের মাখন লাল ভট্টাচার্য দেড় একর জমি দান করেন মন্দিরটি স্থাপনের জন্য।

সরকারের কোনো অনুদান ছাড়াই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মন্দিরটি বাঁচিয়ে রাখায় চেষ্টা চলছে বলে দাবি মন্দিরটির সেবায় নিয়োজিত প্রধান সেবক বা পুরোহিত জয়দেব কুমার ভট্টাচার্যের।

এই পুরোহিত আক্ষেপ করে বলেন, মন্দিরটির সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে অনুদান চেয়ে একাধিকবার আবেদন করলেও অদৃশ্য কারণে বারবারই প্রত্যাখান হতে হচ্ছে। ফলে এই মন্দিরটি বাঁচিয়ে রাখাটাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, খাটরার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ‘সরকার’ নামক জমিদাররা এই বাসুদেব মন্দিরটি প্রথম স্থাপন করেন ‘খাটরা’ গ্রামে প্রাণপুর মৌজায়।

সেখানে মন্দিরটিতে কয়েকশত বছরের পুরনো সাড়ে চার মণ ওজনের কষ্টিপাথরের ‘বাসুদেব’ মূর্তি ছিলো। দেশ স্বাধীনের আগে মন্দিরের কষ্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তিটি কয়েকবার চুরি হলে তা আবার ফিরে পাওয়া গেলেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর ৭৫ এর দিকে বিষ্ণু মূর্তিটি চুরি হলে তা আর ফিরে পাওয়া যায়নি। চুরি হওয়া কষ্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তিটি আর না ফিরে পাওয়ায় এখন ৫০০ বছরের ঐতিহ্য মন্দিরটিতে সিমেন্টের তৈরি একটি ‘বাসুদেব’ মূর্তি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া মন্দিরটিতে এখন শতবছরের পুরনো একটি খাট ও কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। জয়দেব কুমার ভট্টাচার্য নামে একজন পুরোহিত সেখানে পূজা দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলো দেখাশোনা করেন।

সরেজমিনে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাণপুরের ভট্টাচার্য পরিবারের মাখন লালের দেওয়া দেড় একর জায়গায় ওপর নির্মিত মন্দিরটির চাল টিনের ছাউনি বেষ্টিত। চারদিকে খোলা। নেই কোনো প্রাচীর কিংবা বেড়া। মন্দিরটির পবিত্রতা রক্ষাতে নেই কোনো নিরাপদ বেষ্টনিও। মন্দিরটির ভেতর দিয়ে কুকুর-বেড়ালসহ জন্তু জানোয়ার অবাধে চলাচল করছে। কর্তৃপক্ষের মানা থাকা সত্ত্বেও মন্দিরের মূর্তির পাশের দেওয়ালে সাঁটানো হয়েছে স্থানীয় সমাজসেবক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পোস্টার।

এদিকে, মন্দিরটিতে প্রতিবছর জন্মাষ্টমী উপলক্ষে তিনদিন নামকীর্তন এবং দুই দিন পদাবলী হলেও করোনার পর থেকে দু'বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। এই কীর্তন ও পদাবলীতে ৫-৬ হাজার মানুষের সমাগম হতো; তখন কিছু টাকা কালেকশন (চাঁদা) করে মন্দিরটির পরিচালনা ব্যয় করা হতো। এখন সেটাও বন্ধ থাকায় ও সরকারি কোনো অনুদান না পাওয়ায় মন্দিরটির অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া রাত্রে এখানে কোনো পুরোহিত কিংবা সাধু সন্নাসী না থাকায় মাঝে মধ্যেই চুরির ঘটনাও ঘটছে।

স্থানীয়রা জানায়, এই বাসুদেব মন্দিরটি থেকে প্রতিবছরই দোলযাত্রা, রথযাত্রা বের হয়ে থাকে। সেখানে শতশত হিন্দুধর্মাবলম্বীরা অংশগ্রহণ করে। শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এই মন্দিরটি।

প্রাণপুর গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় সমাজসেবক গৌতম ভট্টাচার্য বলেন, মন্দিরটির ইতিহাস ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব ধরে রাখতে অচিরেই সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। না হলে একদিন পুরোপুরি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে মন্দিরটি। তখন শুধু ইতিহাসেই শোভা পাবে মন্দিরটির নাম।

মন্দিরটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি নিতেই চন্দ্র শিকদার বলেন, এটি ফরিদপুরের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। যার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ৫০০ বছরের। কিন্তু এ ঐতিহাসিক মন্দিরটিতে সরকারের সুদৃষ্টি না থাকা বড় কষ্টদায়ক। আমরা আশা করি মন্দিরটি বাঁচিয়ে রাখতে সরকার এগিয়ে আসবেন।

মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দিনু বন্ধু ভট্টাচার্য বলেন, মন্দিরটি আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকারের সুদৃষ্টি না থাকার ফলে কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে প্রাচীন এই স্থাপত্য। যা সত্যিই দুঃখজনক।

তিনি বলেন, এখনও বহু মানুষ প্রত্যেক বছর প্রাচীন নিদর্শন এই বাসুদেব মন্দির দেখতে আসেন। তারাও মনে প্রাণে চাইছেন খাটরার এই প্রাচীন স্থাপত্যগুলি টিকিয়ে রাখতে একটু নজর দিক সরকার। তাহলে আরও বহু বছর টিকে থাকতে পারে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি। তা-না হলে অচিরেই ফরিদপুর তথা ভাঙ্গা উপজেলার ইতিহাস থেকে অচিরেই মুছে যাবে এই বাসুদেব মন্দিরের নিদর্শনগুলি, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: আজিম উদ্দীন বলেন, বাসুদেব মন্দিরটির পুরানো ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরে সঙ্গে কথা বলে যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো: আলিমুজ্জামান বলেন, বাসুদেব মন্দিরে মাঝে মধ্যেই যে চুরির ঘটনা ঘটে তা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কাজ করবে।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, এ মন্দির সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। আমি আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। তবে আমরা এ ব্যাপারে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে মন্দিরটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে কাজ করবো।

নয়া শতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ