ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সাতক্ষীরায় ১২দিনে ৫ আত্মহত্যা, বাড়ছে উদ্বেগ

প্রকাশনার সময়: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:৪৯

সম্প্রতি সাতক্ষীরায় ১২দিনে অন্তত ৫টি আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া অপমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে আরও কয়েকটি। পারিবারিক অশান্তি, হতাশা, তিরস্কার, অপমান ইত্যাদি কারণকেই আত্মহত্যার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ৩১ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব আত্মহত্যর ঘটনা ঘটেছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১১ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার তালায় ইমা খাতুন (১৩) নামে এক স্কুল ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের হাজরাকাটি গ্রামের রফিকুল বিশ্বাসের মেয়ে ইমা খাতুন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। বাড়ি থেকে ইমার মা-বাবা কাজ করতে বাইরে গেলে সে ঘরের ভিতর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মাহত্যা করে। আত্মহত্যার ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।

এদিকে ৯ ফেব্রুয়ারি আশাশুনির যদুয়ারডাঙ্গায় গলায় ফাঁস দিয়ে এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন উপজেলার কাদাকাটি ইউনিয়নের যদুয়ারডাঙ্গা গ্রামের ভবেন্দ্র নাথ সানার পুত্র রাজু সানা (২৫)। নিজ ঘরের আড়ার সাথে শাড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।

তার আত্মহত্যার সঠিক কারণ জানা না গেলেও সম্প্রতি স্ত্রীর স্বর্ণের চেইন বিক্রয় করে ধারদেনা শোধ দেওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দের পর থেকে তিনি চিন্তিত ছিলেন।

এর আগে তালায় ৬ ফেব্রুয়ারি শ্বশুরবাড়ির লোকজনের উপরে অভিমানের জেরে গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে ইমরান হোসেন (২১) নামে এক যুবক আত্মহত্যা করেন। আত্মহননকারী ইমরান তালা উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের অভয়তলা গ্রামের ফেরদৌস হোসেনের ছেলে। খেশরার মুড়াগাছা গ্রামের মাহবুব জোর্দারের মেয়ের সাথে গোপনে বিয়ে করার পর ইমরান চাকরি হারায়। এনিয়ে ইমরান মানসিকভাবে হতাশায় ভুগছিলেন।

৬ ফেব্রুয়ারি তালার খলিষখালী ইউনিয়নের পারকৈখালী গ্রামে নবদ্বীপ (৪২) নামের এক যুবক সবার অজান্তে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। নবদ্বীপ কুমার বাছাড় ডিগ্রি পাশ করে বেকার ছিলেন। বিয়ের বয়স ছাড়িয়ে গেলেও বেকারত্বের কারণে তিনি আজও বিয়ে করেনি। চিন্তা আর হতাশার মধ্যে নবদ্বীপ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

এর আগে ৩১ জানুয়ারি কলারোয়ায় রুমা খাতুন (১৪) নামে এক স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যা করে। সে উপজেলার চন্দনপুর ইউনিয়নের রামভদ্রপুর গ্রামের আবু তাহের বিশ্বাসের কন্যা ও চন্দনপুর হাইস্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। বাড়িতে থাকা বিষ ট্যাবলেট খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে রুমা খাতুন। তাৎক্ষণিক তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে গভীর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।’

এদিকে ৭ ফেব্রুয়ারি দেবহাটায় রোকেয়া খাতুন (৭৭) নামের এক বৃদ্ধার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। রোকেয়া খাতুন দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের জোয়ার গুচ্ছগ্রামের মৃত হাসান আলী তালুকদারের স্ত্রী। তার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে পুলিশ কাজ করছে। পারিবারিক কলহে রোকেয়া খাতুনের হত্যা অথবা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে পারে বলে পুলিশসহ অনেকেই মন্তব্য করেছেন।

এদিকে ৭ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার পার্শ্ববর্তী খুলনার ডুমুরিয়ায় স্বামীর উপর অভিমান করে তানজিলা আক্তার মীম (১৯) নামে এক যাত্রাশিল্পী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। উপজেলার রুদাঘরা গ্রামের নাজমুল হোসেনের সাথে রঘুনাথপুর ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের তানজিলা আক্তার মীমের বিয়ে হয়। স্বামীর সাথে ঝগড়া বিবাদের এক পর্যায়ে নিজ ঘরের আড়ার সাথে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ নানা মানসিক চাপ থেকে আত্মহত্যা করে থাকে। এই সংখ্যা বেশ উদ্বেগজনক বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনও ব্যক্তির আত্মহত্যা করার মানসিকতা তৈরি হলে সেটা তার কাছের মানুষেরা যদি আগেভাগেই বুঝতে পারেন, তাহলে আত্মহত্যা ঠেকিয়ে অনেক মানুষকেই বাঁচানো সম্ভব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একজনের হয়তো ভালোবাসা ভেঙ্গে গেল, একজনের চাকরি নেই, চাকরি চলে গেল। একজন কোনোভাবে বঞ্চিত হলো, একজন মেয়ে ধর্ষিত হলো, একজন ইভ টিজিংয়ের শিকার হলো, পরীক্ষায় ফেল করল, তার জন্য একটি আইনের লড়াই করতে হলো, সামাজিকভাবে হেয় হলো, অপদস্ত হলো-এগুলো হলো আত্মহত্যার উদ্দীপ্তকারী কারণ। যাদের মধ্যে চাপ বহন করার ক্ষমতা কম থাকে, তারা সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে না। তাই আত্মহত্যার আরেকটি কারণ হলো সামাজিক কারণ। যিনি মনে করছেন, আমার সমাজে কোনো জায়গা নেই, সমাজে আমার কোনো প্রয়োজন নেই, আমি সমাজের কাছে একজন উচ্ছিষ্ট ব্যক্তি, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না, আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, সে কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারে। এগুলোতে মোটামুটি আত্মহত্যার কারণ।

বিষণ্ণতা আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। এখানে মানুষ আশাহত থাকে। অসহায়বোধ করে। জীবনের প্রতি তার কোনো মায়া থাকে না। তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। এসব কারণে কিন্তু বিষণ্ণতায় আত্মহত্যার হার বেশি। ৭০ ভাগ মানসিক রোগের কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। এরমধ্যে আবার ৭০ ভাগ কারণ হলো বিষণ্ণতা। যারা মাদক সেবন করে তারাও কিন্তু আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। আত্মহত্যার প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করতে হবে।

অভিভাবক ও পরিবার এখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদের বুঝতে হবে বিষয়টি। তাদের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সমাজও এখানে অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এমনকি মওলানা সাহেব খুব ভালো ভূমিকা পালন করতে পারেন। স্কুলের মাস্টার সাহেব, মাতবর সাহেব কিন্তু ভালো ভূমিকা পালন করতে পারেন। এখানে কিন্তু ধর্মীয় বিষয়টিও রয়েছে। প্রায় সব ধর্মেই কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ। এমন কোনো ধর্ম নেই যেখানে আত্মহত্যা মেনে নেওয়া হয়। সুতরাং এটিও কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হেলথ কেয়ার সার্ভিসটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কারণ হলো মানসিক রোগ। মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদি উন্নত থাকে, যদি জানে এটি একটি মানসিক সমস্যা, তাহলে এটি প্রতিরোধ সম্ভব। মিডিয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আত্মহত্যা করলে একটি পরিবার শেষ হয়ে যায়, আত্মহত্যা দেশের জন্য, মানুষের জন্য কত ক্ষতি, এই প্রভাবটা যদি আমরা তৈরি করতে পারি, বোঝাতে পারি তাহলে ভালো।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ