সাতক্ষীরায় জমির আইল ও মাছের ঘেরের বেড়িবাধে সারি সারি কুল চাষ করে লাভবান হচ্ছে জেলার চাষীরার। কুল বা বরই হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে সাতক্ষীরার আমের পাশাপাশি জেলার কুল বা বরই সুনাম আছে দেশজুড়ে। দেশের প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি কুল চাষ হলেও সাতক্ষীরার কুলের চাহিদা সারা দেশে।
এখানকার মাটি ও আবহাওয়া কুল চাষের উপযোগী হওয়ায় চাষীরা কুল চাষে দিকে ঝুঁকছে। অল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে এর আবাদ। সাতক্ষীরার সুস্বাদু ও উৎকৃষ্ট মানের কুল বরই। সাতক্ষীরা জেলার উৎপন্ন বিষমুক্ত কুল খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় দেশব্যাপী এর চাহিদা রয়েছে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে সাতক্ষীরার শত শত মণ কুল চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মিঠাবাড়ি এলাকার কৃষক আব্দুল গফ্ফার বলেন, ১০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের কুল চাষ করেছি। প্রথম ১’শ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। বিলাতি কুল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। প্রতিদিন ৪ থেকে ৫’শ মণ কুল যাচ্ছে।
একই এলাকার আরেক কুল চাষী আবুল হোসেনের সাথে কথা বলে জানা যায়, চলতি মৌসুমে যার যার নিজের জমি ও লিজ নেয়া জমিতে উন্নতজাতের, বল সুন্দরী, আপেল কুল, বাউকুল, নারকেল ও থাইকুলের চাষ করেছেন। সব কুলে তিনি বিঘাপ্রতি ১০০ থেকে ১২০ মণ হারে ফলন পাবেন বলে আশা করছেন। এ কুল বাগান রোপণ ও পরিচর্যায় প্রতি বিঘায় খরচ হয় ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার মতো। ফলন ভালো হলে ও বাজার মূল্য ভাল পাওয়া গেলে খরচের অর্ধেক লাভ পাওয়া যায়।
বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় জমির আইল ও মাছের ঘেরের বেড়িবাধে সারি সারি কুলগাছ। আকারে ছোট গাছগুলো। বড়জোর চার থেকে পাঁচ ফুট। কুলের ভারে মাটিতে নুয়ে পড়েছে গাছগুলো। বাগান প্রতিনিয়ত কুল তুলছেন চাষীরা। অনেকেই কুল চাষ করে ঘুচিয়েছেন বেকারত্ব।
বাজারে চাহিদার পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়ায় খুশি কৃষক। বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। অল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে এর আবাদ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সাতক্ষীরার উৎপাদিত কুল যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এসব কুলের মধ্যে বাউকুল, আপেলকুল, নারকেলকুল, বিলাতিকুল, নাইনটি ও মিষ্টিকুল অন্যতম। দেশব্যাপী সাতক্ষীরার উৎপাদিত এসব কুল ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলাতে ৬৫৪ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার কুলের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ১০৪ হেক্টর, কলারোয়ায় ৩১৬ হেক্টর, তালায় ১৫৮ হেক্টর, দেবহাটায় ১৬ হেক্টর, কালিগঞ্জে ২০ হেক্টর, আশাশুনিতে ১৫ হেক্টর ও শ্যামনগরে ২৫ হেক্টর। এসব কুলের মধ্যে রয়েছে বাউকুল, আপেলকুল, নাইন্টিকুল, নারকেলকুল, বিলাতিকুল, মিষ্টিকুলী ও টককুল। প্রতি বিঘায় ৭০ থেকে ৮০ মণ উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন কৃষি বিভাগ।
সাতক্ষীরা সদরের কুল চাষী শাহজানা আলী বলেন, চলতি মৌসুমে ৪ বিঘা জমিতে বল সুন্দারী, ভারতী সুন্দরী, নাইন্টি ও মিষ্টি কুল চাষ করেছি। চলতি মৌসুমে এপর্যন্ত প্রায় ২ লাখ টাকার কুল বিক্রি করেছি। তিনি বলেন, প্রতি মন কুল পাইকারী বিক্রি করছেন ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা দরে। জেলার বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা তার থেকে কুল কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় দেখা না দিলে চার বিঘার দুই প্রজাতির কুল অন্তত ৩লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা বিক্রি হবে বলে আশা করছেন এই কুল চাষি। অন্যদিকে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকাতে মিষ্টিকুল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত।
সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের পাশে বাগান থেকে কুল ভেঙে বিক্রি করছেন চাষীরা। চলতি পথে অনেকে গাড়ি থেকে নেমে কুল কিনে বাড়ি ফিরছেন।
আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে নামে একজন ক্রেতা বলেন, কয়েকজন বন্ধু পরিবার নিয়ে গোপালগঞ্জ থেকে সুন্দরবন বেড়াতে এসেছিলাম। ফেরার পথে রাস্তার পাশে কুল বিক্রি হচ্ছে দেখে দেখে নেমে পড়ি। পরে ৫ কেজি কুল কিনেছি। গাড়িতে থাকা অন্যারাও কুল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরার কুলের সুনাম আছে। খেয়ে সুস্বাদু মনে হয়েছে।
উন্নয়ন প্রচেষ্টার কৃষিবিদ নয়ন হোসেন জানান, তালা উপজেলায় অন্যান্য কুলের পাশাপাশি এবার সাড়ে ৯ বিঘা জমিতে অগ্রিম জাতের টক-মিষ্টি কুলের চাষ করা হয়েছে। ফলনও মোটামুটি ভাল হয়েছে। আগাম ফলন হওয়ায় ৯০ থেকে ১৩০ টাকা বাজার দরে বিক্রয় করেছেন চাষীরা। আগামী বছর এই কুলের চাষ আরো বাড়বে বলে তিনি আশাবাদি।
তালার নগরঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান লিপু বলেন, কৃষক ধান আবাদ করে অনেক সময় লোকসানের শিকার হন। তার পরিবর্তে কম খরচে ফসলি জমি ও মাছের ঘেরের বেড়িবাধে দীর্ঘমেয়াদি কুল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। এ জন্য কৃষকেরা বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষে ঝুঁকছেন। তিনি আরো বলেন, গ্রীস্মকালীন টমেটা চাষ পরিদর্শনে এসে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক নগরঘাটা গ্রামকে ‘টমেটা গ্রাম’ নামে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। উৎপাদন এবং রপ্তানী বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে নগরঘাটা ইউনিয়নে একটি অর্থনৈতিক জোন হলে এই এলাকার কৃষকরা উপকৃত হবে।
সাতক্ষীরা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরার কুল বেশ সুস্বাদু, মিষ্টি ও পুষ্টিকর। জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রতি মৌসুমে সাতক্ষীরা থেকে শত শত মণ কুল চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সাতক্ষীরায় কুলের ভাল ফলন হয়েছে। কৃষকরা দামও পাচ্ছে ভাল। ফলে এবার কুল চাষীরা বেশ লাভবান হবে। সরকার কুল চাষীদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছে। তিনি আরো বলেন, প্রায় গত দুই দশক থেকে সাতক্ষীরা জেলায় বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষ শুরু হয়। ফসলটি লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই এর আবাদ বাড়ছে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ