দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে 'উত্তরা গণভবন' নামকরণের ৫০ বছর আজ। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীকে উত্তরা গণভবন হিসেবে নামকরণ করেন। এর একমাস পরে বঙ্গবন্ধু উত্তরা গণভবনের মূল প্রাসাদের ভেতরে মন্ত্রীসভার একটি বৈঠকও করেন। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে মন্ত্রীপরিষদের মিটিং হয়। সেই থেকেই ঢাকার বাহিরে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় বাসভবন হিসেবে পরিচিত উত্তরা গণভবন। এরআগে ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সপরিবারে এ গণভবনে সফরে আসেন।
সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে উত্তরা গণভবনকে ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দরা দাবি করেন এ গণভবনে যেন আবারো মন্ত্রীপরিষদের মিটিং হয়।
জানা যায়, নাটোর ছিল বঙ্গবন্ধুর অনেক পছন্দের জেলা। নাটোরকে নিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু নাটোরকে উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র করতে চেয়েছিলেন। দেশের দ্বিতীয় রাজধানী করার স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। নাটোরের স্থানীয় রাজনীতিকেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বের সাথে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু উত্তরা গণভবনে সফরকালে রাজবাড়ি চত্বরে একটি ‘হৈমন্তী’ গাছ রোপণ করেছিলেন।
১৯৬৪ সালের ৮ মে নাটোর মহকুমা আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি ছিলেন। শুধু তিনি একাই নন, ওই সময়ের আওয়ামী লীগের খ্যাতনামা নেতাদেরকেও তিনি নাটোরে উপস্থিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও সম্মেলনে আরও যারা ছিলেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, মতিয়ার রহমান, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, কামরুজ্জামানসহ অনেকে।
এই গণভবনটি ৪২ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। বিশালাকার এ রাজবাড়িতে রয়েছে দিঘী, বাগান, ইটালিয়ান গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, নতুন সংগ্রহশালাসহ দেশ-বিদেশের হরেক ও বাহারী রকমের গাছের মেলা। পুরো গণভবনের চারপাশে উঁচু দেওয়াল দ্বারা ঘেরা।
নাটোর শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার উত্তরে ইতিহাস খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা ‘উত্তরা গণভবন’ অবস্থিত। বর্তমানে এ গণভবন জনপ্রিয় এক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। যদিও করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘ কয়েক মাস যাবত বন্ধ রয়েছে। এ গণভবন প্রাঙ্গণে আছে ইতালি থেকে সংগৃহীত মনোরম ভাস্কর্যে সজ্জিত বাগান। যেখানে রয়েছে বিরল প্রজাতির নানা উদ্ভিদ। গণভবনের সামনের মাঠে ফুটেছে দৃষ্টিনন্দন গাঁদা ও গ্লাডিওলাস ফুল। গণভবনে ঢুকলেই যেন পর্যটকদের ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাস দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। অন্যদিকে দর্শনার্থীরাও গণভবনে ঢুকেই আগে ফুলের কাছে গিয়ে তুলেন ছবি।
গণভবনের ইতিহাস
নাটোরের রানী ভবানী তার নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করে। এরপর ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজপ্রাসাদটি পরিত্যক্ত থাকে। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এ ভবনটিকে সরকারি প্রাসাদের হিসেবে এ সংস্কার করে। চারদিকে মনোরম লেক, সুউচ্চ প্রাচীর পরিবেষ্টিত ছোট-বড় ১২টি কারুকার্যখচিত ও দৃষ্টিনন্দন ভবন রয়েছে। যা আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে ‘উত্তরা গণভবন’। সেই সময়ের বাংলার রাজা-জমিদারদের মধ্যে দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। দয়ারাম রায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
১৬৮০ সালে নাটোরের প্রখ্যাত কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিলেন নরসিংহ রায়। নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের অধীনে চাকরি করতেন সে সময়ে তিনি কাজ উপলক্ষে চলনবিল এলাকার কলম গ্রামে পৌঁছান। রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ন ঠাকুরের অধীনে কর্মচারী ছিলেন তখন দয়ারাম তার মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকুরি করতেন। পরে সামান্য লেখাপড়া করে জমা খরচ রাখার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন। রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়নের স্নেহ, ভালবাসা ও সহানুভূতি পেতে থাকেন তিনি। বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের প্রিয়ভাজন হওয়ায় দয়ারাম জমিদারী লাভ করেন।
প্রথমে রাজা রামজীবনের একজন সাধারণ কর্মচারী থাকলেও প্রতিভা, দক্ষতা আর বিশ্বস্ততা দিয়ে নাটোর রাজের দেওয়ান পর্যন্ত হয়েছিলেন দয়ারাম। রাজা রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম রায় নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
যশোহরের রাজা সীতারাম রায় বিদ্রোহী হলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাটোর রাজের দেওয়ান দয়ারাম এর সাহায্যে তাকে দমন ও পরাজিত করে নাটোর কারাগারে বন্দি করে রাখেন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করায় নবাব সরকারের দয়ারামের প্রভাব বেড়ে যায় এবং তিনি ‘রাই রাইয়া’ খেতাবে ভূষিত হন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করে তিনি মূল্যবান সম্পদসমূহ লুণ্ঠন করেন। তবে সীতারামের গৃহদেবতা কৃষ্ণজীর মূর্তি ছাড়া সব রামজীবনের হাতে অর্পণ করেন। দয়ারামের এহেন ব্যবহারে রামজীবন খুশি হয়ে দয়ারামকে কৃষ্ণজীর মূর্তি স্থাপনের জন্য পুরস্কার স্বরূপ দিঘাপতিয়ায় একখণ্ড জমি দান করেন। সেই সাথে বর্তমান বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা এলাকার নওখিলা পরগনাও দান করেন। এটিই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারী। পরে তিনি লাভ করেন পরগনা ভাতুরিয়া তরফ নন্দকুজা, যশোহরের মহল কালনা ও পাবনা জেলার তরফ সেলিমপুর। এভাবে দিঘাপতিয়া রাজবংশের ও জমিদারীর গোড়াপত্তন ১৭৬০ সালে হয়।
বর্তমানে এই রাজপ্রাসাদ থেকে হারিয়ে যাওয়া রাজা-রানীর ব্যবহৃত ঐতিহাসিক সব নিদর্শন উদ্ধার করে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণ করা হয়েছে। রয়েছে পাখিদের একটি অভয়াশ্রমও।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মো. শামীম আহমেদ বলেন, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ৯ ফ্রেব্রুয়ারি উত্তরা গণভবন নামকরণ করেন। এরপর থেকেই গণভবনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত। স্থানে যেন আবারো ছোট আকারে হলেও যেন একটি মন্ত্রীপরিষদে মিটিং করা যায়, সেজন্য জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে প্রদেক্ষেপ গ্রহণ করবো।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ