ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের প্রাক্তন আ. লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসেম (৯৪) আর নেই। রাজনীতির জন্য জীবন উৎসর্গীত এই মহান ব্যক্তির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দিন অতিবাহিত হয়েছে স্বজনদের কাছে। আবুল হাসেম ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নৌকা নিয়ে দুবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জীবন কাটিয়েছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। খদ্দরের পাঞ্জাবি, পাজামা, গায়ে মুজিব কোট, মাথায় গান্ধী টুপি দেখে যে কেউ বলে দিতে পারতেন তিনিই গফরগাঁওয়ের প্রিয় হাসেম ভাই।
বুধবার (২ ফেরুয়ারি) সকালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আদরের এই এমপির বার্ধক্যের কারণে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছিল। তিনি সময় কাটাতেন টেলিভিশন দেখে আর নাতনির পাঠ করা দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শুনে।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওনার যাপিত জীবন ছিল হুইল চেয়ার নির্ভর। পক্ষাঘাতগ্রস্থ অবস্থায় আবুল হাসেম পাঁচ বছর আগে চলৎশক্তি হারিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। এ সময় তার দেখাশোনা করতেন স্বজনরা। সর্বশেষ স্ত্রীও ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে যান। তখন থেকেই তিনি অনেকটাই নিঃসঙ্গ একাকী জীবন যাপন করছিলেন। কর্মব্যস্ত জীবনে স্বজনদের ইচ্ছা থাকা সত্বেও সব সময় পাশে থাকতে পারতেন না। বলতে গেলে তার ছায়া সঙ্গী হয়ে ছিলেন নাতনী শিরিন আকতার।
স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রাক্তন এমপি আবুল হাসেম নিজ এলাকার তিনশত কিলোমিটার কাঁচা ভাঙাচোড়া রাস্তাঘাট স্বেচ্ছা শ্রমদানের মাধ্যমে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে চলাচল উপযোগী করেছিলেন। তা দেখতে ছুটে আসেন আ.লীগ কেন্দ্রিয় নেতা কামরুজ্জামান ও আব্দুর রাজ্জাক। সে সময় তারা আবুল হাসেমর এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের ভূয়সী প্রশাংসা করে বঙ্গবন্ধুকে বিষয়টি অবহিত করেন। এছাড়াও নারী সমাজকে তিনি নানাভাবে উদ্ধুদ্ধ করেছেন। সেলাই মেশিন দিয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে উপার্জনের পথ দেখিয়েছেন। সময়টা ছিল ১৯৭২ সাল। তখন নারী সমাজ ঘর হতে পা ফেললে বেপর্দা বলে নিগৃহীত হতেন। এইসব অপবাদ উপেক্ষা করে আবুল হাসেম সাহেবের দেখানো পথে গফরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী সমাজ আর্থ সামাজিক মুক্তির পথ খুঁজে পায়। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় অবকাঠামোতে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন তিনি। গঠন করেন পল্লী উন্নয়ন সংস্থা (পউস)। এই সংস্থার মাধ্যমে বেকার যুবকদের নানামুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ করেন। আজো আবুল হাসেমের পল্লী উন্নয়ন সংস্থা অনবদ্য রোল মডেল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আবুল হাসেম প্রথমে পাড়ি জমান ভারতে। সেখান থেকে পরে অংশনেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু যখন বলেছিলেন ‘তিন বছর কিছুই দিবার পারব না’, তখন হাসেম ভাই ডাক দেন প্রিয় গফরগাঁও বিনির্মাণের।
১৯৩১ সালের ১৭ আগস্ট জন্ম নেয়া আবুল হাসেম স্কুলজীবনেই ভারতীয় কংগ্রেস দলের ছাত্রসংগঠনের একজন কর্মী হিসাবে যুক্ত হন ছাত্ররাজনীতিতে। বিপ্লবী যুগান্তর দলের কমরেড ফণিলাল বল ছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু।
১৯৫০ সালে গফরগাঁও কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রথম ব্যাচের ছাত্র থাকাকালে তিনি ছিলেন ছাত্র সংসদের ভিপি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনের জন্য ঘুরে বেড়ান সারা এলাকায়। ২১ ফেব্রুয়ারি গফরগাঁওয়ের আব্দুল জব্বার ঢাকায় শহীদ হয়েছেন শুনে ছাত্র-যুবকদের এক বিশাল দল নিয়ে ঢাকায় ছুটে যান। শহীদ জব্বারসহ ভাষাশহীদদের রক্ত কপালে মেখে দীপ্ত শপথ নিয়েছিলেন এই আবুল হাসেমসহ গফরগাঁওয়ের সঙ্গীয় ছাত্র-যুবকরা।
১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে পরের বছর ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগীর পক্ষে গফরগাঁও-ভালুকা অঞ্চলে ক্যাম্পিং করেন আবুল হাসেম। ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সব আন্দোলনেই একনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি।
১৯৪৬ সালে নেতাজি সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রথম গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন আবুল হাসেম। দ্বিতীয় ও শেষবার কারাবরণ করেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর। তখন বিনা বিচারে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুই বছর জেলে রাখা হয় বঙ্গবন্ধুর আদরের এমপি আবুল হাসেমকে।
আবুল হাসেম সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় গড়ে তোলেন অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, অন্তত ২০টি হাই স্কুল ও গফরগাঁওয়ের একমাত্র মহিলা কলেজ। তার বদৌলতে এলাকার শত শত বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি গফরগাঁওয়ে গড়ে তোলেন লঙ্গরখানা। গফরগাঁওয়ের প্রবীণ সাংবাদিক সেই সময়ের তরুণ কমিউনিস্ট নেতা ফকির এ মতিনের পরিচালনায় লঙ্গরখানায় প্রতিদিন শত শত ভূখা অনাহারি মানুষ খাবার খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন।
শুধু রাজনীতিকই নন, সাহিত্য-সংস্কৃতির একজন একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন আবুল হাসেম। তারই প্রত্যক্ষ সহায়তায় গফরগাঁওয়ে ১৯৭৫ সালে তটিনী খেলাঘরের মাধ্যমে শুরু হয় সাস্কৃতিক ও শিশু-কিশোর আন্দোলন। আবুল হাসেমের লেখা ‘যখন এমপি ছিলাম’ বইটি গফরগাঁওয়ের ইতিহাস ঐতিহ্যর একটি প্রামান্য দলিল। অর্থাভাবে বইটি তিনি আর পূনঃপ্রকাশ করতে পারেননি। রাজনৈতিক জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৬০ বছর বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ