ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘বখতিয়ার ভাই, একটু বের হবেন’

প্রকাশনার সময়: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৭:০০

‘বখতিয়ার ভাই, একটু বের হবেন একজন মানুষকে শনাক্ত করতে হবে। আপনি চেনেন কি না? ওসি প্রদীপের এমন আহ্বানের পর একজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাড়ির দরজা খুলে দেন আমার স্বামী। বাড়ির দরজা খুলতেই ওসি প্রদীপ ও পুলিশ দল ছোঁ মেরে বখতিয়ার মেম্বারকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেন। দ্রুত গাড়িতে তুলে পুলিশ চলে যান তাদের গন্তব্যে। পরে বন্দুকযুদ্ধের নামে আমার স্বামীকে হত্যা করে।’

কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য বখতিয়ার মেম্বারের স্ত্রী শাহীনা বেগম আবেগাপ্লুত কন্ঠে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন।

তিনি জানান, পরদিন আবারো বখতিয়ার মেম্বারের বাড়িতে পুলিশ আসে। এ সময় বাড়ি থেকে লুট করা হয় নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ অর্ধ কোটি টাকার মালামাল। তার স্বামী তিনবার নির্বচিত ইউপি সদস্যছিলেন এবং তার স্বামী বখতিয়ার মেম্বারের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা ছিল না, তিনি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের ব্যবসার দেখাশোনা করতেন।

কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কাউকে পাত্তাই দিতেন না প্রদীপ। এসময় মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ১৬১ জনকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগ রয়েছে প্রদীপের বিরুদ্ধে। তবে সিনহা হত্যায় প্রদীপের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসার পরই মূলত মুখ খুলতে শুরু করেন ভুক্তভোগীরা।

জানা গেছে, মাদক নির্মূলের বাহানায় ক্রসফায়ারের নামে কন্ট্রাক্ট কিলিং, লোকজনকে জিম্মি করে টাকা আদায়, এমনকি ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রদীপের ‘আগ্রাসনে’র অভিযোগ রয়েছে বোনের জায়গার ওপরও! অভিযোগ রয়েছে, অনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে প্রদীপ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, মোটা অংকের চাঁদা না পেয়ে অথবা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ওসি প্রদীপ এসব মানুষকে হত্যা করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা খুবই নির্মম ও চাঞ্চল্যকর। যা মেনে নেওয়ার মতো নয়।

টেকনাফ ও মহেশখালীতে থাকাকালীন ওসি প্রদীপ কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু মৃত্যুর ঘটনা ছিল লোমহর্ষক ও অত্যন্ত নির্মম। বন্দুকযুদ্ধের নামে একই পরিবারের তিন ভাই, দুই ভাই, বাবা-ছেলে, ভায়রা-ভগ্নিপতিকে একসঙ্গে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

২০২০ সালের ২৩ জুলাই গভীর রাতে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের তৎকালীন ইউপি সদস্য বখতিয়ার আহমেদ কে নিজ বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যান টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও উখিয়া থানার তৎকালীন ওসি মরজিনা আক্তার।

পরদিন ২৪ জুলাই দিবাগত রাতে খবর আসে হ্নীলায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বখতিয়ার মেম্বার, পুলিশ জানায় ঘটনাস্থল থেকে ইয়াবা সহ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। বখতিয়ার মেম্বারের তিন পুত্রকে জড়ানো হয় মামলায়।

এ ঘটনার মাত্র সাতদিন পর ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, দুটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বেশ আলোচনায় ছিল। এর একটি হচ্ছে পূর্ববিরোধের জের ধরে আমানুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক (৩৭) ও আজাদুল ইসলাম আজাদ (২৩) নামে দুই ভাইকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে ধরে টেকনাফে এনে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

নিহতদের মধ্যে আজাদুল ইসলাম আজাদ ঘটনার মাত্র ১০ দিন আগে বাহরাইন থেকে দেশে এসেছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কারাগারে গেলে দুই বছর পর এ ঘটনায় মামলা দায়ের করে নিহতদের পরিবার।

গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা মামলার এজাহারে নিহতদের ছোট বোন রিনাত সুলতানা শাহীন উল্লেখ করেছিলেন, ছোট ভাই আজাদুল ইসলাম আজাদ পাঁচ বছর বাহরাইনে কর্মরত ছিলেন। পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের জুন বা জুলাই মাসে তিনি বিদেশ থেকে ফেরেন। বড় ভাই আমানুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক (৩৭) দেশে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করতেন। আজাদ দেশে আসার খবর পান টেকনাফ থানার ওসির দায়িত্বে আছেন প্রদীপ কুমার দাশ।

২০১৮ সালের ১৩ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে চন্দনাইশের কাঞ্চননগর রৌশন হাট ফকিরপাড়ার সামনে রাস্তা থেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে এক দল লোক দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। পরে ১৫ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করা হয়।

ওই দিন রাত ১টার দিকে তাদের মায়ের কাছে ফোন করে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এর মধ্যে ১৬ জুলাই সকাল ৭টায় প্রদীপ কুমার দাশ বাদীর মায়ের মোবাইলে কল করে ফারুক ও আজাদের মরদেহ চিহ্নিত করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। পরে পরিবারের লোকজন গিয়ে তাদের মরদেহ নিয়ে আসে। দুই ভাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন বলে জানানো হয়।

স্বজনদের অভিযোগ, চট্টগ্রামে দায়িত্বে থাকাকালে প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে দুই ভাই ফারুক ও আজাদের মামলা সংক্রান্ত কারণে বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জের ধরে দুই ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নিহত ইউপি সদস্যের ছেলে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তার টার্গেট ছিল বাবাকে হত্যা করে টাকা লুট করা; সেটি তিনি করেছেন।’

হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘ওসি প্রদীপ একজন দানব। তার হাতে খুন হয়েছে বহু নিরীহ মানুষ। সর্বশেষ আমার বাবা বখতিয়ার উদ্দীন মেম্বারকে ওসি প্রদীপ হত্যা করেন। আমরা বিশ্বাস করি আমার বাবা নির্দোষ ছিলেন। তাই তাকে নির্মমভাবে হত্যার অভিশাপ পড়েছে ওসি প্রদীপের ওপর। তার জ্বলন্ত প্রমাণ মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে আরেক নির্দোষ ব্যক্তি সিনহাকে হত্যা করে ফেঁসে গেছেন প্রদীপসহ ও তার সহযোগীরা।’

একইভাবে টেকনাফের তিন সহোদর, দুই সহোদর, বাবা-ছেলে ও ভায়রা-ভগ্নিপতিকে একসঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার সহযোগীরা। স্বামীকে হত্যার পর স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে থানায় আটকে ধর্ষণের ঘটনাও আছে বেশ কয়েকটি। সে সময় প্রদীপ কুমার দাশের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের চাকরিজীবনের পুরোটাই সমালোচনা ও বিতর্কে ভরা। বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে চাকরিজীবনে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হয়েছেন কমপক্ষে পাঁচবার। প্রতিবার কোনো না কোনো খুঁটির জোরে ফিরেছেন স্বপদে। পদে ফিরেই ধারণ করেছেন হিংস্ররূপ।

২০১৭ সালে মহেশখালী থানায় ওসি হিসেবে যোগ দিয়ে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণের নামে নিত্যনতুন কৌশলে অপকর্ম করতে থাকেন তিনি। তবে টেকনাফ থানায় যোগদানের পর বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন প্রদীপ। ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে নিয়মিতভাবে টাকা আদায়, লুটপাট, মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাতসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ক্রসফায়ার ও মামলার ভয় দেখিয়ে ধনী পরিবারগুলোর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে প্রদীপের বিরুদ্ধে।

এছাড়া হোয়াইক্যংয়ের আনোয়ার নামে এক ব্যক্তিকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর প্রতিকার চাইতে আনোয়ারের স্ত্রী ও বোন আদালতে গেলে তাদের উঠিয়ে নিয়ে পাঁচ দিন আটকে রাখার বিষয়টিও এলাকায় সবার মুখে মুখে। তবে প্রদীপের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি।

প্রসঙ্গত, সোমবার (৩১ জানুয়ারি) মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় প্রদীপ কুমার দাশকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় দেন।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ