মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারপুর গ্রামের ৩ মেয়ে ও ১ ছেলেকে নিয়ে টানাটানির সংসারে ভ্যানচালক বাবা শাজাহান হাওলাদার ছেলে ইমরান হাওলাদারকে ধার দেনা সুদে টাকা এনে স্বপ্নের ইটালী পাঠায়। সাড়ে ৪ লাখ টাকায় লিবিয়া পর্যন্ত পাঠাতে দালাল সামাদকে দিতে হয়। লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দিতে দালাল আহম্মদকে পরিশোধ করে আরো সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এরপর সাগরে তুষার ঝড়ে সলিল সমাধি ঘটে প্রিয় ছেলের। সন্তান হারিয়ে পরিবারটি এখন পাগল প্রায়। একদিকে সন্তান অপরদিকে দেনার বোঝায় জর্জরিত পরিবারটি। শুধু ইমরানই নয় দালালের মাধ্যমে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ঠান্ডায় প্রাণ হারায় মাদারীপুরের ৫ তরুন। এদের অনেকের পরিবারকেই দালালরা আশ্বাস দিচ্ছে তাদের সন্তানরা এখনো বেঁচে আছে।
সরেজমিনে নিহতদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ জানুয়ারি অবৈধভাবে সমুদ্রপথে লিবিয়া হয়ে কাঠের তৈরি অভিবাসনপ্রত্যাশী ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালীর উদ্দেশ্যে রওনা হয় মোট ২৮৭ জন যাত্রী। এদের মধ্যে ২৭৩ জনই বাংলাদেশী। বাকি সবাই মিশরীয় নাগরিক। তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে গেলে প্রবল ঝড়ো বাতাসের পর টানা ছয় ঘণ্টা বৃষ্টিপাতের কবলে পড়ে ঠান্ডায় মারা যায় ৭ বাংলাদেশী। ২৫ জানুয়ারি বিষয়টি জানতে পারে বাংলাদেশ ইতালির দূতাবাস।
সংশ্লিষ্ট সুত্রের বরাতে ৭ জনের মারা যাওয়ার খবর নিশ্চিত ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস। বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র নিশ্চিত করে মারা যাওয়া ৭ বাংলাদেশি মধ্যে ৫ জনই মাদারীপুর জেলার। মাদারীপুরের ৫ জন হলেন- সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারপুর এলাকার মো. ইমরান হাওলাদার (২৩), একই ইউনিয়নের বরাইল বাড়ি এলাকার প্রেমানন্দ তালুকদারের ছেলে জয় তালুকদার (১৮), মস্তফাপুর ইউনিয়নের চতুরপাড়া এলাকার শাহজালাল মাতুব্বরের ছেলে জহিরুল ইসলাম শুভ (২০), বাপ্পি, রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের উমারখালী এলাকার সাফায়েত মোল্লা (২০)।
নিহত ইমরানের বোন পপি আক্তার বলেন, আমার বাবা ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। একটু ভাল থাকার আশায় আদরের একমাত্র ভাইটারে ধার দেনা করে বিদেশ পাঠাইলাম। অনেকেই অনেক ধরনের খবর দিছে, আমরাও বুঝি কিন্তু মনতো মানে না। আমরার ভাই এই দুনিয়ায় নাই, আমরা বিশ্বাস করি না।
নিহত ইমরানের চাচা লিয়াকত হাওলাদার বলেন, আমরা দালালের কাছে জানতে পারলাম আমার ভাতিজা বাইঁচা আছে। আপনাদের কাছে শুনলাম আমার ভাতিজাও অন্যদের সাথে মারা গেছে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি আমার ভাতিজার লাশটা যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করে। আর মিথ্যাবাদী দালালদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়।
নিহত জয় তালুকদারের মা লক্ষী রানী তালুকদার বলেন, আমার ছোট ছেলে আমাদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করার জন্য ইতালী যেতে চাইলো। আমি মানা করা স্বত্ত্বেও লিবিয়া গেলো। স্বপ্নের ইতালী আর যাওয়া হইলো না। আমার ছেলের লাশটা ফেরত চাই। আপনারা দয়া কইরা লাশটা আইনা দেন।
নিহত জয়ের বাবা পলাশ তালুকদার বলেন, ধার দেনা করে সাড়ে ৭ লাখ টাকা চুক্তিতে ছেলেকে ইতালীর উদ্দেশ্যে পাঠালাম। কিন্তু লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দেয়ার সময়ই মৃত্যু হলো। আর দালাল একবারও খবর নিলো না। দালালদের বিচার চাই।
পেয়ারপুর ইউপি চেয়ারম্যান লাবলু হাওলাদার বলেন, ‘লিবিয়া হয়ে ইতালী যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ঠান্ডায় অসুস্থ্য হয়ে আমাদের এলাকার দুটি ছেলেসহ মাদারীপুরের ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের লাশ সরকার যেন দ্রুত দেশে আনার ব্যবস্থা করে এই দাবি জানাই। আর যে সকল দালাল মানুষকে লোভ দেখিয়ে অবৈধভাবে সাগরপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইতালী পাঠায় তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, ইতালী যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে মাদারীপুরের যে ৫ জন মারা গেছে তাদের সঠিক তথ্য নিশ্চিত করে ইতালী দূতাবাসকে জানালে তারা লাশ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে বলে ইতালী কাউন্সিলরের জয়েন্ট সেক্রেটারী জানিয়েছেন।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ