ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পাটখড়ির ছাই আনছে বৈদেশিক মুদ্রা

প্রকাশনার সময়: ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৬:৫৯

‘জুট ইজ দ্যা গোল্ডেন ফাইবার অফ বাংলাদেশ’। পাট হয় বাংলাদেশের সোনালী আশ। এক সময় সোনালী আশ থাকলেও মাঝখানে হয়ে উঠেছিল কৃষকের গলার ফাঁস। বর্তমানে আবার পাটের সুদিন ফিরে আসছে। কাঁচা পাট রপ্তানীর পাশাপাশি পাটজাত বিভিন্ন দ্রব্যও বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে। এই মুহুর্তে পাট রপ্তানীতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

তবে পাট বা পাটজাত দ্রব্য নয় সম্ভাবনার নতুন খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে পাটখড়ির ছাই বা ছাই থেকে তৈরি কার্বন। পাটখড়ি পুড়িয়ে তৈরি করা হয় চারকোল পাউডার বা কার্বন। এ কার্বন চীনসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়। কার্বন থেকে তৈরি হয় কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, আতশবাজি, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনপণ্য প্রভূতি।

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নের জয়নগরে গড়ে উঠেছে ২টি কার্বন ফ্যাক্টরি। একটি গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরি অপরটি কে এইচ কার্বন ফ্যাক্টরি। ময়না ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে মধুমতির পাড়ে রুইজানি গ্রামে রয়েছে আরও একটি কার্বন ফ্যাক্টরি। এটি ইমপিগনো প্রাইভেট কোম্পানির একটি প্রতিষ্ঠান।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, তিনটি ফ্যাক্টরিই উৎপাদনে রয়েছে। ফ্যাক্টরিগুলোতে কার্বন উৎপাদনের কাঁচামাল হাজার হাজার মণ পাটকাঠি মজুদ করা হয়েছে। পাটকাঠি প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রতি বছর কমপক্ষে ৬ মাস এ ফ্যাক্টরিগুলো চালু থাকে। জুলাই-আগস্ট মাস থেকে পাটকাঠি উঠা শুরু হয়। পাটকাঠি উঠার পর অক্টোবর থেকে মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত মিলগুলি উৎপাদনে থাকে। বাকি ৫ বা ৬ মাস বন্ধ থাকে।

জয়নগরের গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরি এ অঞ্চলের প্রথম ফ্যাক্টরি। চাইনিজরাই মূলত এটি প্রায় ৮/১০ বছর আগে গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে হাতবদল হয়ে বর্তমানে এটির মালিক আওয়ামী লীগ নেতা হীরু মুন্সি।

তিনি বলেন, ফরিদপুর জেলা পাট চাষের জন্য বিখ্যাত। প্রচুর পরিমাণ পাট উৎপাদন হয় এখানে। কার্বনের কাঁচামাল পাটখড়ি এবং শ্রমিক সহজলভ্য হওয়ায় এ অঞ্চলে কার্বন ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বোয়ালমারী অঞ্চলের তিনটি ছাড়াও পাশের মধুখালী, আলফাডাঙ্গা, সালথায় একাধিক কার্বন ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এ এলাকার কার্বন চীনে রপ্তানি হলেও চীনের বাইরে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, তাইওয়ানসহ আরও কিছু দেশে পাটখড়ির কার্বনের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরির পাশেই গড়ে উঠেছে কে এইচ কার্বন ফ্যাক্টরি। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খন্দকার রুহুল আমিন ২০১৬ সালে জমি লিজ নিয়ে এই ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন।

২০১৯ সালে মিলটি কার্বন উৎপাদন শুরু করে। ফ্যাক্টরির দায়িত্বে থাকা সবুজ মিয়া বলেন, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মিল চালু থাকে। প্রতিদিন চারশ মণ পাটখড়ির প্রয়োজন হয়। প্রতি মণ পাটখড়ি থেকে প্রায় ১০ কেজি চারকোল পাউডার বা কার্বন উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি কার্বন ৪৫টাকায় বিক্রি করা হয়। পাটখড়ি ২২০ টাকা মণ দরে ক্রয় করেন। তাদের ফ্যাক্টরিতে ২০জন লোক কাজ করে বলে জানান তিনি।

রুইজানিতে অবস্থিত কার্বন ফ্যাক্টরিটি ২০১৬ সালে ইমপিগনো প্রাইভেট লি. স্থাপন করে। পরের বছরই ফ্যাক্টরিটি উৎপাদনে যায়। এ কারখানার ম্যানেজার খোরশেদ আলম বলেন, কার্বনের ৯৫ভাগ আমদানি করে চায়না। বাকি ৫ ভাগ অন্যান্য দেশ আমদানি করে।

তিনি বলেন, তারা চারকোল পাউডার বা কার্বন থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনপণ্য, দাঁত পরিস্কারের ওষুধ ও খেতের সারসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছে।

তিনি আরো বলেন, পাটকাঠি বিশেষ চুল্লিতে লোড করে আগুনে জ্বালানো হয়। এভাবে ১০/১২ ঘণ্টা জ্বালানোর পর চুল্লিটির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে কোনভাবে অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে চারদিন রাখার পর সেখান থেকে বের করে ক্র্যাশিং করে কার্বন প্যাক করা হয়।

খোরশেদ আলম জানান, ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতি চালানে ৮ কন্টিনার বা সাড়ে ১২ কেজির ৬ হাজার বস্তা কার্বন উৎপাদন করা হয়। এই পরিমাণ কার্বন উৎপাদনে খড়ি লাগে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ মণ। প্রতি কেজি পাটকাঠি থেকে এক কেজি কার্বন উৎপাদন হয় বলে তিনি জানান।

কার্বনের বিক্রি বা সরবরাহ ঢাকার প্রধান কার্যাল থেকে হয়ে থাকে এবং সব লেনদেনই ডলারে হয়ে থাকে। তাঁরা প্রতি মণ পাটকাঠি বর্তমানে ৩’শ টাকা করে ক্রয় করেন। করোনার (কভিড-১৯) কারণে ব্যাবসা একটু মন্দা।

আনুমানিক হিসাব দিয়ে খোরশেদ আলম জানান, প্রতি মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা তাদের লাভ থাকে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা এবং লাভবান ব্যবসা বলে উপজেলার গুনবহা গ্রামের কাজী আজিজুল হকের ছেলে কাজী সাকলায়েন আজিজ রথি গুনবহা মাঠে একটি কার্বন ফ্যাক্টরি স্থাপনের কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু পরিবেশ দুষণের কথা বলে এলাকার কিছু লোকজন তা বন্ধ করে দেয়।

মালিকরা লাভ করলেও কার্বন ফ্যাক্টরিরগুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে ফ্যাক্টরির ভিতরে যারা কাজ করে তাদের মুখে মাস্ক নেই, মাথায় মাথাল নেই। নেই বিশেষ কোন পোষাক। শ্রমিকদের সারা শরীর ছাই আর ময়লায় মাখামাখি। শ্বাসকষ্টসহ নানা রকম রোগের ঝুঁকি রয়েছে এ সকল শ্রমিকের। চুল্লির পাইপ ছোট হওয়ায় ছাই ময়লা ফ্যাক্টরির পাশের ফসলি জমির ক্ষতি করছে। কে এইচ এবং ইমপিগনো কার্বন ফ্যাক্টরির ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্রসহ সব কাগজপত্র আছে বলে জানায় তবে কেউ তা দেখায়নি। গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরির কাগজপত্র নাই বলে জানা গেছে।

মধুখালীতে জিনসিং ট্রেডিং কোম্পানী লিমিটেড নামে গড়ে উঠেছে একটি কার্বন ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরিটির মালিক চীনা নাগরিক ওয়াং চুয়াং লি। ২০১৩ সালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক সংলগ্ন উপজেলার দিঘলিয়া নামক স্থানে ফ্যাক্টরি স্থাপন করে উৎপাদন শুরু করেন। ১৮টি চুল্লির মাধ্যমে পাঠকাঠি পুড়িয়ে কার্বন তৈরি করা হয়।

ফ্যাক্টরিটির মালিক চীনা নাগরিক ওয়াং চুয়াং লি বাংলা ভাষায় কথা বলতে না পারায় কথা হয় ফ্যাক্টরিটির ম্যানেজার আব্দুর রহিম এর সাথে। আব্দুর রহিম জানান, ২০১৩ সালে ফ্যাক্টরির উৎপাদন শুরু হয়। শুরু থেকেই আমি এখানে দায়িত্ব পালন করছি। ১৮টি চুল্লি রয়েছে, প্রতিদিন ৩০টন পাঠকাঠির প্রয়োজন হয়। ভালই চলছিল, কিন্তু করোনার কারনে ব্যবসা কিছুটা মন্দ।

কার্বন ফ্যাক্টরি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিসিএমইএ) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে চারকোল রপ্তানি হয় চার হাজার ১৮২ দশমিক ২৭ টন। প্রতি টনের মূল্য ছিল ৭০০ ডলার। এ হিসাবে চারকোল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৮৯ ডলার বা প্রায় ২৪ কোটি ৮০ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

অন্যদিকে, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ২০০৯-১০ সালে বিদেশে চারকোল রপ্তানি শুরু হয়। এ খাত থেকে বছরে ৩২ কোটি ২৫ লাখ ডলার রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার এ খাত থেকে বছরে রাজস্ব পেতে পারে ৪০ কোটি টাকা। প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে।

মধুখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, কার্বন ফ্যাক্টরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি স্থানীয় আর্থসামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখছে। পাটকাঠি রান্নার জ্বালানি আর বেড়া দেওয়ার কাজে ছাড়া আর কিছুতে লাগতো না। এখন পাটকাঠি বিক্রি করে কৃষক টাকা পাচ্ছে। পাশাপাশি অনেকে ব্যবসা করে স্বাবলম্বি হচ্ছে। এ কারণে বেকার সমস্যাও হ্রাস পাচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ