এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধার দেখা মিললো বরিশাল নৌ-বন্দরের টার্মিনালে। শীত নিবারণের চেষ্টা চালাচ্ছেন প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে। ঘুমানোর চেষ্টাও করছেন, কিন্তু হচ্ছে না। একবার উঠছেন আবার শুয়ে পড়ছেন। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলাম। বললেন, আকিকা বেগম। বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী। কথাও ভালোভাবে বলতে পারছিলেন না।
শীত নিবারণের আর কোনও কিছু নেই এমন প্রশ্নে বৃদ্ধা বলেন, ‘টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না, কম্বল কিনবো কীভাবে? প্লাস্টিকের বস্তা জোগাড় করে নিয়েছি। এটা গায়ে জড়িয়ে রাত কাটাই। মানুষের কাছে চেয়ে যা পাই, তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। শুনেছি কারা নাকি কম্বল দিয়েছে, কিন্তু আমি পাইনি। কম্বল পেতেও গায়ে জোর লাগে। ভিড় ঠেলার সেই জোর তো আমার নেই। পারলে একটা ভালো কম্বল দেন। মন খুলে দোয়া করবো।’
আকিকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে টার্মিনালে বাস করা একাধিক শিশু এসে ভিড় জমায়। তাদেরও আবদার একটা কম্বল দেন। সজীব, অমিত হাসান ও জিদ্দি হাওলাদার জানায়, টার্মিনালের প্ল্যাটফর্ম লোহার হওয়ায় রাতে বেশ ঠাণ্ডা থাকে। হালকা বাতাস বইলে খুব কষ্ট হয়। ঘুম হয় না। সারা রাত জড়সড়ো হয়ে থাকি। টিকতে না পারলে আগুন জ্বালিয়ে শীত ঠেকানোর চেষ্টা করি।
তারা আরও জানায়, ভোরে ঢাকার লঞ্চ ঘাটে ভিড়লে সেখানে যাই। মেশিনের পাশে গরম থাকায় সেখানে ঘুমাই। বুধবার রাতে একদল লোক কম্বল বিতরণ করেছে, কিন্তু আমাদের দেয়নি। তারা কয়েকজনকে দিয়ে, ছবি তুলে বাকি কম্বল নিয়ে চলে গেছে। আমরা কম্বল চাইলে ধমক দিয়েছে।
বরিশাল নদীবন্দরে ভাসমান অর্ধশতাধিক মানুষের নেই ভারী কোনও শীতবস্ত্র। এ জন্য যার যা আছে তা দিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চলে। ফ্লোর ও লোহার প্ল্যাটফর্ম কাগজের বাক্স বিছিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে তারা। সরকার থেকে কম্বল পাবো, তবে শীত যাওয়ার পর। শুরুতে কম্বল পাই না। শীত শেষে সবাই কম্বল নিয়ে আসে। তখন কম্বল দিয়ে কি করবো। ঘরবাড়ি না থাকায় কম্বল রাখারও ব্যবস্থা নেই। প্রতিবছরই দানের কম্বল নষ্ট হলে ফেলে দেওয়া হয়। কেউ কেউ আবার বিক্রিও করে বলছিলেন অনেকে।
অভিযোগ রয়েছে ভূরি ভূরি। কম্বল দিতে কেউ এলে অসহায় মানুষকে সরিয়ে বাগিয়ে নেন অনেকে। অসহায়দের অনুরোধ, ‘আমাদের নাম লিখে নিন। যেদিন কম্বল দেবেন, সেদিন নাম ধরে ডাকবেন, তাহলেই কম্বল পাবো।’
মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বরিশাল নৌ-বন্দর ও বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে দেখা যায়, কেউ বস্তা, কেউ পাতলা কাপড় পরে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। যাদের কিছু নেই তারা জড়সড়ো হয়ে বসে আছেন।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশালের সদস্য সচিব রফিকুল আলম বলেন, ‘সরকার থেকে উচিত শীত শুরুর আগের ছিন্নমূল মানুষগুলোর জন্য কম্বল বরাদ্দ দেওয়া। কম্বল সঠিক সময়ে বিতরণ করা দরকার। শীতের শেষ মুহূর্তে কম্বল বিতরণ হয়, যা ছিন্নমূল মানুষের কোনও কাজে আসে না।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (গোপনীয় শাখা) সুব্রত বিশ্বাস জানান, বিভিন্ন সংগঠন ও অসহায় মানুষের মাঝে জেলা প্রশাসক প্রায় সাড়ে চার হাজার শীতবস্ত্র, কম্বল ও গরম কাপড় বিতরণ করেছেন। তবে ৪২ হাজার শীতবস্ত্র ইতোমধ্যে এসেছে। আরও ৫০ হাজার শীতবস্ত্রের চাহিদা রয়েছে বলে জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। বরিশাল নৌ-বন্দর থেকে শুরু করে সড়কের পাশে এবং নগরীর দুটি বাসস্ট্যান্ডে রাত কাটানো মানুষগুলো এখনও জেলা প্রশাসনের কোনও সহায়তা পাননি।
সুজনের সদস্য সচিব বলেন, যাদের মাধ্যমে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে, তাদের শীতার্ত মানুষের কাছে যেতে হবে। না হলে সংকট থেকেই যাবে।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ