নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে চলনবিল যাদুঘর অবস্থিত। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ যাদুঘরের নামে সাইন বোর্ড আছে। আছে পুড়নো একটি ভবনও। তবে যাদুঘরে রক্ষিত দুর্লভ প্রাচীন নিদর্শনগুলোর কিছুই সেখানে নেই। নিদর্শন না থাকায় যাদুঘরটিতে নেই লোক সমাগমও। যাদুঘরটির সর্বত্র এখন অযত্ন-অবহেলার ছাপ। যাদুঘরটি রক্ষায় নেওয়া হচ্ছেনা কোনো সরকারি উদ্যোগ।
সরেজমিনে জানা যায়, আবু বক্কার নামের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী যাদুঘরটি দেখভাল করছেন। ওই কর্মচারী দিয়েই কয়েক বছর ধরে চলছে যাদুঘরের কার্যক্রম।
দায়িত্বে থাকা ওই কর্মচারী জানান, নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে এবং রাসায়নিক পরিচর্যার জন্য যাদুঘরে রক্ষিত লক্ষী, সরস্বতী ও কৃষ্ণ মূর্তীসহ বেশ কিছু মূল্যবান নিদর্শন প্রায় ৫ বছর আগে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। তা এখনো ফেরত দেওয়া হয়নি।
এদিকে স্থানীয়রা বলেছেন- চলনবিল অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের ধারক বাহক এই চলনবিল জাদুঘর। এটি ১৯৯৪ সালে সরকারিকরণ করা হয়। মূলত এরপর থেকেই যাদুঘরের অবস্থা আরো নাজুক হতে থাকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় যথাযতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি জাদুঘরে রক্ষিত নিদর্শনাবলী। ফলে অযত্ন অবহেলায় ইতোমধ্যেই বিনষ্ট হয়ে গেছে অনেক দূর্লভ প্রাচীন নিদর্শন। এই দীর্ঘ সময়েও যাদুঘরটির জনবল ও অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে একজন মাত্র কর্মচারী দিয়েই যাদুঘরের কার্যক্রম চলছে। যাদুঘরে রক্ষিত নির্দশনাবলি হলো- জাদুঘরে প্রবেশ পথেই রয়েছে চলনবিলের কৃতি সন্তান প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের পোড়া মাটির আশ্চর্য মূর্তি। এছাড়া সংগৃহিত রয়েছে, দুর্লভ নিদর্শনের মধ্যে তুলট কাগজ, গাছের ছালে লেখা প্রাচীন-মধ্যযুগের পুঁথির পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন সময়ের স্বর্ণ, রৌপ্য। আছে তাম্র ও ধাতব মূদ্রা, সুলতান নাসির উদ্দিনের নিজ হাতে লেখা পবিত্র কুরআন শরীফ, বিভিন্ন ধরনের প্রস্থর, পোড়া মাটির ভাস্কর্য মূর্তি, রাজা, সম্রাট, সুলতান-নবাবদের ব্যবহৃত তরোবারিসহ যুদ্ধাস্ত্র, রানী ভবানীর স্মৃতি চিহ্ন, মনসা মঙ্গলের বেদি-ঘট, বগুড়ার কবি মরহুম রুস্তম আলী কর্নপূরীর দলিল-দস্তাবেজ ও উপ-মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে সংগৃহিত ঐতিহাসিক নিদর্শন।
গুরুদাসপুর মডেল প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রভাষক মাজেম আলী মলিন জানান, জায়গা জটিলতা ও রাজস্ব আদায় না হওয়ার অজুহাতে জাদুঘরটি অন্যত্র স্থানান্তরের চেষ্টা করেছিল প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর। কিন্তু এলাকাবাসীর দাবির মুখে তা সম্ভব হয়নি। এখনো নতুন ভবন নির্মাণ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে ৮ শতাংশ জায়গা রেজিষ্ট্রিমূলে জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু করা হয়। সেই সাথে চলনবিল তথা উপ-মহাদেশের অনেক দূর্লভ নিদর্শন সংগ্রহ করে আনা হয় এ জাদুঘরে। যা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সংগ্রহ ছিল। পরবর্তীতে জাদুঘরটি উন্নয়নের লক্ষে নরওয়ে সরকারের প্রজেক্ট নরওয়ে এজেন্টি (নোরাট) ১লাখ ২০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করে, যা দিয়ে জাদুঘরের পাঁকা দো-তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। জাদুঘরটি আরো সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষে বেসরকারি পর্যায় থেকে সরকারি পর্যায়ে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় জাদুঘরটি বগুড়া মহাস্থান গড়ে অবস্থিত মহাস্থান জাদুঘরের অধিনস্থ করা হয়। নিয়োগ দেওয়া হয় একজন কর্মকর্তা ও ৩ জন কেয়ারটেকার। সর্বশেষ প্রায় ১০ বছর আগে আখতার হোসেন নামের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করা ছাড়া সরকারিভাবে আর কোনে উন্নয়ন কার্যক্রম না থাকায় জাদুঘরটি বেহাল অবস্থায় পর্যবসিত হয়।
চলনবিল জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, জাদুঘরের উপরের ৩টি কক্ষ ব্যবহারের অনুপোযোগী হওয়ায় তা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এখন নিচের ২টি কক্ষে রয়েছে সংগ্রহিত নিদর্শনাবলী। অফিসে কর্মকর্তা পর্যায়ের কাউকে পাওয়া যায়নি। ভবনটি দীর্ঘদিন যাবৎ সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। জাদুঘরটির পাশেই রয়েছে খুবজীপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও খুবজীপুর এম.হক ডিগ্রী কলেজ।
খুবজীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম দোলন বলেন, জাদুঘরে যাওয়ার জন্য সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এখন প্রয়োজনীয় লোকবলসহ সুষ্ঠ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জাদুঘরটি দর্শক হারাচ্ছে। চলনবিলে অনেক গুনীমানুষের জন্ম। চলনবিলের ইতিহাস ঐতিহ্য সংগ্রহণ করে চলনবিলকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু জাদুঘরটি সরকারিকরণের পরে আরো শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। যে প্রত্যাশা নিয়ে এলাকাবাসী জাদুঘরটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিল তার বিন্দু মাত্রও পূরণ হয়নি। বরং উন্নয়নের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনিত হয়েছে যাদুঘরটি।
প্রত্নতত্ব বিভাগের বগুড়ার আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা জানান, চলনবিল জাদুঘরের জন্য নতুন ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। তবে অনেক নিদর্শনাবলী রাসায়নিক পরিচর্যার জন্য পাঠানো হয়েছে। কাজ শেষ হলেই সেগুলো যাদুঘরে ফেরত দেওয়া হবে।
নয়া শতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ