ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন অঞ্চল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ২০০ অবৈধ ট্যুরিস্ট জিপ

প্রকাশনার সময়: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:৫১

ক্ষমতাসীন শ্রমিক সংগঠনের নাম ব্যবহার করে একটি চক্রের নেতৃত্বে কক্সবাজার ও বান্দরবনের সমস্ত পর্যটন অঞ্চল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুইশতাধিক অবৈধ ট্যুরিস্ট জীপ। এগুলো স্থানীয়দের কাছে চান্দের গাড়ি হিসেবেও পরিচিত।

রামুর সাইফুল ও কলাতলীর জামাল নামে এই দুই ব্যাক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে এসব গাড়ি। নামকাওয়াস্তে একটি সমিতি গঠন করে নিজেদের সভাপতি-সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে ছড়ি ঘুরাচ্ছেন শতাধিক যান শ্রমিক ও পর্যটকদের উপর। হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ফলে পর্যটক হয়রানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সব অনুষঙ্গ। রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, চাঁদাবাজি ও মাদক পাচারের মতো ভয়াবহ অভিযোগও।

অনুসন্ধানে জানা যায়- সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে চলে এসব গাড়ি। গাড়ি প্রতি ৪০০ টাকা মাশোয়ারা দিয়ে সড়ক মহাসড়ক পথ ব্যবহার অঘোষিত ভাবে বৈধ করে নিয়েছে চক্রটি।

কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে মেরিনড্রাইভ সড়ক হয়ে কলাতলী, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী, পাটুয়ারটেক, টেকনাফ জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত এবং মহাসড়কে রামু, নাইক্ষ্যংছড়ি, গর্জনিয়া, ডুলাহাজারা ও বান্দরবন পর্যন্ত বিচরণ করছে আইনগত ভাবে বাজেয়াপ্ত এসব যন্ত্রযান।

যদিও এধরণের গাড়িগুলো ৯০ দশকের দিকে কক্সবাজারের কলাতলী বালুচরের উপর দিয়ে টেকনাফ পর্যন্ত পর্যটক ও যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করতো। কিন্তু এখন সেসব গাড়ি এখন উঠে এসেছে সড়কের উপর। ফলে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।

প্রতিনিয়ত ঘটছেও তাই। গেল মাসে টেকনাফের শামলাপুর এলাকায় এধরণের একটি ট্যুরিস্ট জীপের ধাক্কায় ১০ পথচারী আহত হয়। ওই ঘটনায় গাড়িটি স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।

আরও জানা যায়- বছর বিশেক আগে কক্সবাজারের যানবাহন শ্রমিকদের সংগঠন কার মাইক্রোবাস মালিক চালক সমিতির অধীনে এই গাড়িগুলো চলতো। কিন্তু গত ১০/১২ বছর আগে উক্ত শ্রমিক সংগঠন থেকে বের হয়ে যায় তারা। পরে শ্রমিক লীগের সুগন্ধা ইউনিটের নেতাকর্মীরা তাদের নিজস্ব ক্ষমতা ব্যবহার করে নতুন করে ট্যুরিস্ট জীপ গাড়ির লাইন চালু করে।

গঠন করেছে ট্যুরিস্ট জীপ মালিক চালক সমিতি নামে একটি ভুঁইফোড় সংগঠনও। বিশেষত কথিত সভাপতি জামাল ও ক্যাশিয়ার সাইফুল এখন লাইনটির দেখভাল করছে। এজন্য তারা গাড়ি পিছু হাতিয়ে নিয়েছেন কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা করে।

এভাবে করে দুইশতাধিক গাড়ি থেকে হাতিয়েছেন কোটি টাকা। এর উপর প্রশাসনকে দেওয়ার কথা বলে নিয়মিত আদায় করছেন চারশো টাকা করে চাঁদা। শ্রমিক চাঁদা তো আছেই। এছাড়াও ভাড়া আদায়ের কোনো নীতিমালা না থাকায় পর্যটকদেরও পকেট কাটছে এসব গাড়ির মালিক চালকেরা। যার কাছ থেকে যেভাবে পারছে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে নিচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়- গাড়িগুলোর কোনো ধরণের ফিটনেস নেই। কারণ এসব গাড়ি সরকারী বিভিন্ন সংস্থা হতে বাজেয়াপ্ত ঘোষণার পর নিলামে বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে অল্পমূল্যে ক্রয় করে জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহারের জন্য সড়কে নামিয়েছে কতিপয় দুর্বৃত্ত।

রুটপারমিট, লাইসেন্স, ইন্স্যুরেন্স কোনো কিছু না থাকা সত্বেও বছরের পর বছর ধরে কীভাবে চলছে এসব গাড়ি প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে। অধিকাংশ ড্রাইভারদের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। বখাটে ও মাদকাসক্ত এক শ্রেণির যুবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এসব গাড়ির স্টিয়ারিং। পান থেকে চুন খসলেই গন্ডগোল বাঁধিয়ে ফেলে পর্যটকদের সঙ্গে। চাহিদা মত টাকা না দিলে সবাই একযোগে জড়ো হয়ে পর্যটকদের জিম্মি করে হাতিয়ে নেন প্রয়োজনের দ্বিগুণ অর্থ। সড়কেও অনেকটাই বেপরোয়া থাকে এসব গাড়ির চালক ও তাদের গতিবিধি। ফলে মাদক পাচারসহ যেকোনো ধরণের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে দুস্কৃতিকারীরা।

২০১৯ সালের শুরুতে সদরের পিএমখালী এলাকার যুবক আরিফ মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় এধরণের একটি ট্যুরিস্ট জীপ রামুর চাকমারকুল মাদ্রাসা গেইট সংলগ্ন মহাসড়কে পিষে দিয়ে চলে যায়। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে বিচার চাইতে গেলে কথিত এই কর্তৃপক্ষ গাড়িটি তাদের নয় বলে ঘটনার দায় নিতে অস্বীকার করে।

নাম্বার না থাকায় ভুক্তভোগী পরিবার গাড়িটিকে চিহ্নিত করতেও ব্যর্থ হয়। ফলে ঘটনাটি হারিয়ে যায় অন্ধকারে। অভিযোগ রয়েছে- গাড়িতে সর্বদা পর্যটক থাকায় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীও তাদের তল্লাশী কিংবা নজরদারী করার প্রয়োজন মনে করে না। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে সীমান্তবর্তী টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার ও অন্যান্য চোরাচালানির কাজে ব্যবহার হচ্ছে।

এছাড়াও মাদকাসক্ত পর্যটকদের মাঝে ইয়াবা ও আইসসহ ভয়ঙ্কর সব মাদকদ্রব্য সরবরাহ করার গুরুত্বর অভিযোগ রয়েছে এসব গাড়ির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে।

গাড়িগুলো রাখার জন্য কোনো পার্কিং নেই। কলাতলীর সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে ডলফিন মোড় পর্যন্ত অলিতে গলিতে যেখানে সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এসব গাড়ি। এভাবে অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে পথচারী ও পর্যটকদের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে যানজটও। এব্যাপারে প্রশাসনও অনেকটাই নির্বিকার। গাড়িগুলো অবৈধ জানা সত্ত্বেও নেওয়া হয়নি কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা। বন্ধে তৎপর নয় তারাও।

এই লাইনে যাদের গাড়ি রয়েছে তারা হলেন- করিমের সর্বাধিক ১২টি, নুরুচ্ছফার ১০টি, ফরিদের আটটি, নান্নু, ফারুক, জসিম ও সিরাজের তিনটি করে, বাপ্পী বড়ুয়া, সাইফুল, রিয়াজ, কালু, বেদারুল ইসলাম ও দুদুর দুইটি করে গাড়ি রয়েছে।

এছাড়াও পুতু, জামাল, মুন্না, দাড়ি রফিক, শাহেদ, মনছুর, আরিফ, এহেসান, আলমগীর, সাদ্দাম, করিম, কাউসার, নজরুল এবং বিপুলের রয়েছে একটি করে গাড়ি।

পর্যটন এলাকায় অবৈধ যানবাহন সরবরাহ এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারে অভিযুক্ত জামাল ও সাইফুলের সঙ্গে কথা হলে তারা প্রতিবেদককে পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বক্তব্য দেয়। জামাল প্রথমে পুলিশকে মাশোয়ারা দিয়ে এসব গাড়ি চালানোর কথা স্বীকার করলেও পরে তা অস্বীকার করে। অন্যদিকে সাইফুল প্রতিমাসে চাঁদা তুলে প্রশাসনকে মাশোয়ারা প্রদানের কথা অনায়সে স্বীকার করে। তারা দুজনে এটাও দাবী করেছেন- জেলা প্রশাসক, ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশকে রিকুইজিশনের সময় এসব গাড়ি সরবরাহ করে থাকে। তাদের এই দাবীর পক্ষে কিছুটা সত্যতাও মিলে এক ট্রাফিক কর্মকর্তার বক্তব্যে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম.এম. রকিবুর রেজা মুঠোফোনে জানান- এসব গাড়ির মালিকেরা এসে কক্সবাজারের নানা ধরণের ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক দাবী করে এসব গাড়ি চালাচ্ছে। আমরাও ভেবেছি হয়তো এরা পর্যটনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এদের মধ্যে অনিয়মে জড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। এ ধরণের ২০টি মতো গাড়ি এখন আমাদের হেফাজতে রয়েছে। কিন্তু অবৈধ গাড়ি কীভাবে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে; সেই সঙ্গে সরকারি কাজে রিকুইজিশনে এসব গাড়ি ব্যবহার করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এবং কোনো দুর্ঘটনার দায় কে নিবে জানতে চাইলে তিনি এই মুহুর্তে মন্ত্রী মহোদয়ের রিসিপশনের কাজে ব্যস্ত আছেন দাবি করে পরে বিস্তারিত জানাবেন বলে বিদায় নেন।

নয়া শতাব্দী/এমএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ