বরিশাল নগরীতে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা তিন প্রকল্প বাস্তবায়ন এখন ভাগ্যবিধাতার হাতে আটকে আছে। কাজ সম্পূর্ণ শেষ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রায় ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা দুটি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু মিলনায়তন, ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের দুই প্রবেশদ্বারে নির্মাণাধীন সিটি গেট। আদৌ এসব প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ হবে কি-না তা নিয়েও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) সূত্র জানায়, পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরে দুটি পানিশোধনাগারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এ কাজ বাস্তবায়ন করেন। নগরের উত্তরে পলাশপুরের ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এবং দক্ষিণ দিকে রূপাতলী এলাকায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শোধনাগার দুটির নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করা হয় ২০১৫ সালের জুন মাসে।
কিন্তু সিটি করপোরেশনের কাছে ২৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়ার কারণে ওজোপাডিকো দুই বছরেও শোধনাগার দুটিতে বিদ্যুৎসংযোগ দেয়নি। ফলে পানি শোধনাগার দুটি ওই সময় চালু করা যায়নি। এরপর ২০১৮ সালে পানি শোধনাগার দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তা আর একদিনের জন্যেও চালু করা যায়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, পলাশপুরের শোধনাগারটির মূল ফটকের সামনের অংশের প্রায় ৪’শত ফুট এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পূর্ব পাশের বিশাল অংশ ইতোমধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙন এখন প্ল্যান্টের খুব কাছে চলে এসেছে। প্ল্যান্টে চলাচলের সড়কটির নিচের মাটি ধসে গেছে। পূর্ব পাশের কেমিক্যাল ভবন, ট্যাংকি ও পানি ধরে রাখার পুকুরগুলোর পাড় পর্যন্ত ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত। নিচের মাটি ও বালি ধসে যাওয়ায় একটি ভবনের একাংশ শুধু পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় ভেতরের হাউসে পানি জমে শেওলা পড়ে শুকিয়ে আছে। অন্য যন্ত্রপাতিগুলোতেও মরচে ধরে গেছে অকেজো হয়ে আছে। একই অবস্থা রূপাতলী শোধনাগারটিরও।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা সূত্র জানায়, দুটি শোধনাগারেরই নির্মাণ ত্রুটি ছিল। একইসঙ্গে স্থান নির্বাচনেও ত্রুটি ছিল। বিশেষ করে বেলতলার পলাশপুরের শোধনাগারটি নদীভাঙনে বিলীন অবস্থা। ফলে এসব অব্যবস্থাপনা এবং অপরিকল্পিত নির্মাণ ত্রুটির কারণে পুরো প্রকল্পই মানুষের কোনো কল্যাণে আসেনি।
সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের বাস্তবায়ন সংস্থা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মঈনুল হাসান বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের কাছে আমরা প্ল্যান্ট দুটিকে বুঝিয়ে দিয়েছি। কিছু মেরামত আর সঠিক ব্যবস্থাপনায় এটা চালু করা সম্ভব।’
এদিকে অনিশ্চিত বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়ামের প্রকল্পটিও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বরিশালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশেই বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়ামের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা ছিল বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি)। কিন্তু আধুনিক সুবিধা-সংবলিত পাঁচতলা বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনের নির্মাণকাজ ৭ বছরেও শেষ হয়নি। কাজ শুরুর পর দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় মেয়াদের এক বছর পার হলেও নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর প্রায় চার বছর ধরে কাজ বন্ধ আছে।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি নগরের সদর রোডের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উত্তর পাশের জমিতে ১৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫’শত আসনের পাঁচতলা এই মিলনায়তন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কার্যাদেশে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এর নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারিত থাকলেও পরে নকশা পরিবর্তন হওয়ায় মিলনায়তনটির নির্মাণব্যয় বাড়িয়ে ২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এ সময় নির্মাণকাজের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হয়।
কিন্তু দ্বিতীয় দফায় সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও মিলনায়তনটির নির্মাণকাজ আজও সম্পন্ন হয়নি। মেসার্স কোহিনূর এন্টারপ্রাইজ ও মোমেন সিকদার নামের দুটি যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজ পায়। দেখা যায়, ভবনের কাজ শেষ হলেও ভেতরের বেশ কিছু দেয়ালে কাজ এখনো বাকি। এ ছাড়া ভেতর ও বাইরের সাজসজ্জার (ডেকোরেশন) অনেক কাজ পড়ে আছে। কাজও বন্ধ প্রায় চার বছ ধরে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের একটি সূত্র জানায়, নকশায় পরিবর্তন আনায় ওই সময় এর নির্মাণব্যয় ও সময়সীমা বাড়িয়ে ছিল তৎকালীন মেয়র ও তার পরিষদ। কিন্তু নতুন করে যে নির্মাণব্যয় বেড়েছিল, সেই অর্থ সরকারি তহবিল থেকে না দিয়ে সিটি কর্পোরেশনকে নিজস্ব তহবিল থেকে নির্বাহ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কিন্তু তৎকালীন সময়ে সিটি কর্পোরেশননে আর্থিক সংকটের কারণে সেই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। ফলে এর বাকি কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
দুই প্রকল্পের মতই আরেকটি বড় প্রকল্প মুখ থুবড়ে আছে। প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটিও শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। মাঝ পথে কাজ থমকে আছে এখনো।
বরিশাল মহানগরের দুই প্রান্তে প্রবেশ মুখে সিটি গেট নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়ে আর শেষ হয়নি। ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে মহানগরের দুই গেট। দুটি গেটের একটির মাত্র ৩৩ ভাগ এবং অন্যটির ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছিল। সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, বরিশাল মহানগরের বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গড়িয়ারপাড় এলাকা এবং বরিশাল-কুয়াকাটা সড়কের মহাসড়কের নগরীর রুপাতলীর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতুর ঢালে ওই গেট দুটি নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ১১ জুন। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ছয় বছর একই অবস্থায় পড়ে আছে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ জানায়, ২০১৫ সালের ১১ জুন নগরের গড়িয়ারপাড় এবং শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতু এলাকায় দুটি সিটি গেট নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। গড়িয়ারপাড় এলাকার জন্য ২ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় ধরে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিতুসী ট্রেডার্সকে কাজ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে কাজ শেষ করার কথা ছিল। তারা কাজ শুরুও করে। মাত্র ৩৩ ভাগ কাজ শেষ করে। এরপর আর কাজ এগোয়নি।
অন্যদিকে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবত সেতুর ঢালে গেট নির্মাণের জন্য ২ কোটি ৩৬ লাখ ৯২ হাজার ৩২৬ টাকা বরাদ্দ করা হয়। একই সময়ের কার্যাদেশ হলেও কাজ শুরু করতে দেরি হয়। তবে এই গেট নির্মাণের ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মো. ফারুক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনের বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য দরপত্র আহবানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। আর সিটি গেট নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিষয়টি কি করা যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।’
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ