প্লাস্টিক পণ্যের প্রভাবে বাজার থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে পরিবেশ সম্মত বাঁশ ও বেত শিল্প। স্বল্প পুঁজিতে রোজগার কম হওয়ার কারণে এ শিল্পীরা এখন ভিন্ন পেশায় ঝুঁকছেন। তারপরেও অনেকেই স্বল্প পুঁজি দিয়েই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার শহরের সন্নিকটে পুর্বমৌকুড়ী ঋষিপল্লী। এ পল্লীর ৩৫টি পরিবারের বেশির ভাগই বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি করে ডালা, কুলা, সের, ধামা, চালুন, খৈ চালাসহ গ্রামাঞ্চলের কৃষক পরিবারের কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র। এ পল্লীর বেশিরভাগ কর্মজীবি নারী স্বল্প পুঁজিতে কাজ করছেন। তাদেরকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
রুপালী দাস। বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের পুর্বমৌকুড়ি গ্রামের প্রদীপ দাসের স্ত্রী। স্বামী সেলুনের কাজ করলেও তিনি বাড়িতে বসে না থেকে বাড়ির কাজের পাশাপাশি করেন বাঁশের তৈরি চালুন ও কুলা তৈরির কাজ। ২ ছেলে লেখাপড়া করছে আর মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তার ১৬-১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের পর অভাবের সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আনতে বাঁশের তৈরি কুলা ও চালুন তৈরির কাজ করে আসছেন। পুঁজি স্বল্পতা ও অর্থাভাবে ১-২টা করে বাঁশ ক্রয় করে কাজ করেন। এতে তার সপ্তাহে ৫-৬শত টাকা আয় হয়। পুঁজি বাড়লে আয়ও বেশি করা সম্ভব। তিনি বলেন, সরকারিভাবে সহজ শর্তে ঋণ বা এককালীন অনুদান দিলেও তাদের ব্যবসা প্রসার করে সংসারে স্বচ্ছলতা আনা সম্ভব বলে সহায়তার দাবি জানান।
শেফালী দাস। তিনিও পুর্বমৌকুড়ী গ্রামের মিলন দাসের স্ত্রী। তার স্বামীও সেলুনের কাজ করেন। ২ ছেলে একজন এসএসসি পাশ করার পর গ্রীলের কাজ শিখছে আর ছোট ছেলে চয়ন দাস অষ্টম শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। তিনিও বাঁশের দিয়ে আসবাবপত্র তৈরির কাজ করেন। নিজের স্বল্প পুজিতে বাঁশ ক্রয় করে তৈরি করি। এতে সপ্তাহে ৫-৬শত টাকা আয় হয়। ১৪-১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। আর্থিক সহায়তা বা সহজ শর্তে ঋণ পেলে আরো বেশি আয় করা সম্ভব। আর বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি করতে বাজারে যেতে হয় না। বাড়ি থেকেই বিক্রি করা হয়। অর্থের অভাবে অনেক সময় কাজ বন্ধ করতে হয়। তবে নিজে আয় করার কারণে সংসারে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করে নেয়।
চন্দনা দাস। তিনি পুর্বমৌকুড়ী গ্রামের সত্য দাসের স্ত্রী। ২ সন্তান। একজন স্কুলে যায় ও অন্যজনের এখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। সেও বাঁশ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরির কাজ করেন। বাড়ির কাজের পাশাপাশি স্বামীর সহযোগিতায় এ কাজ করেন। প্রতিটি কুলা তৈরি করতে ২৫-৩০টাকা খরচ হয়। ৫০টাকা বিক্রি করি। বাজারে গিয়ে বিক্রি করতে হয় না। বিভিন্ন লোকজন এসে বাড়ি থেকে ক্রয় করে নিয়ে যান। তবে তিনিও দাবি করেন আর্থিকভাবে সহায়তা পেলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।
আদুরী দাস। তিনি পুর্বমৌকুড়ী গ্রামের অরুন দাসের স্ত্রী। স্বামী বেতের কাজ করলেও বেতের দাম বেশি ও পুঁজি না থাকার কারণে তিনি এখন বেকার। নিজে বাঁশের কাজ করে প্রতি সপ্তাহে ৭-৮শত টাকা আয় হয় তা দিয়েই কোন মতে সংসার চলে। ২ মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ২ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে অন্তু সেলুনের কাজ করে। বেতের আসবাবপত্রের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও পুঁজির অভাবে কাজ বন্ধ রয়েছে। সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা বা সহজশর্তে ঋণ পেলে বাঁশ ও বেতের তৈরির কাজের ব্যপ্তি ঘটানো সম্ভব।
ইতি দাস। তিনি পুর্বমৌকুড়ী গ্রামের চিত্ত দাসের স্ত্রী। বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র তৈরি করেই চলে তার সংসার। এক মেয়ে স্কুলে পড়ে। সপ্তাহে ৫-৬শত টাকা আয় হয়। তবে অর্থাভাবে এ কাজ খুড়িয়ে খুড়িয়ে করতে হচ্ছে। সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে সংসারে স্বচ্ছলতা ও ব্যবসার পরিধি বাড়ানো সম্ভব হবে।
অবহেলিত ও অসহায় ঋষি জনগোষ্টির অদম্য মেধা দিয়ে তৈরি বাঁশ ও বেত শিল্পকে রক্ষায় সরকারিভাবে সহজ শর্তে ঋণ বা সরকারি অনুদান দিয়ে এদের পাশে দাঁড়ানো হলেই টিকবে এ শিল্প। এদের পাশে দাঁড়াতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এগিয়ে আসার আহবান জানাই।
রাজবাড়ি জেলা দলিত পঞ্চায়েত ফোরামের সাধারণ সম্পাদক বিপুল কুমার দাস বলেন, ‘বাঁশ ও বেতের অগ্নিমূল্যের কারণে পুঁজির অভাবে বেশিরভাগ বাঁশ ও বেঁত শিল্পীদের দুর্দিন চলছে। কারণ এসব কাজ করে নারীরা। সরকারিভাবে আর্থিক সুবিধা, অনুদান বা সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে এদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা সম্ভব।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো: হাসিবুল হাসান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বির্নিমানে। সকল পেশার মানুষের অংশগ্রহণে স্বপ্নপূরণ হবে। আমরা পুর্বমৌকুড়ী ঋষিপল্লীর বাঁশ ও বেত শিল্পীদের সব সময়ই সহযোগিতা করে থাকি। তারা যদি আমাদের কোন সহযোগিতা চান তাহলে অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ