দীর্ঘদিনেও সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় অস্তিত্ব সংকটে পরেছে কালের সাক্ষী গাইবান্ধার তুলসী লাহিড়ীর জমিদার বাড়িটি। অবহেলা আর অযত্নে মুছে যেতে বসেছে ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত নাট্যকার ও চলচিত্রভিনেতা ইতিহাসের পাতায় লেখা নাম তুলসী লাহিড়ীর শেষ চিহ্ন টুকু।
কে এই তুলসী লাহিড়ী? অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না তার জন্ম ও কর্মময় জীবনের নানা স্মৃতি ও জীবনের ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার নলডাংগা ইউনিয়নে পিতা সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ও মা শৈলবালা দেবীর কোল জুড়ে জন্ম নেন তুলশী লাহিড়ী। কালের বিবর্তনে কালজয়ী এই মহাপুরুষের সবকিছুই আজ নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। গাইবান্ধা জেলা থেকে প্রায় ১১ কি. মি. সাদুল্লাপুর উপজেলা। সেখান থেকে ১১ কি. মি. দুরে নলডাঙ্গা ইউনিয়নে অবস্থিত তুলশী লাহিড়ীর এই জমিদার বাড়িটি। পিতার সঙ্গীত চর্চায় তুলসী লাহিড়ীর হাতে খড়ি। পিতার অনুপ্রেরণায় তুলসী লাহিড়ী বিনোদন জগতেও ধীরে ধীরে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে গোটা উপমহাদেশে খ্যাতি অর্জন করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তুলশী লাহিড়ীর স্মৃতি বিজড়িত ও ইতিহাস খ্যাত কালের সাক্ষী গৌরবোজ্জ্বল জমিদার বাড়িটির চারিদিকে ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ঢাকা। এক সময়ের ঐতিহ্যবহনকারী শৈশব, কৈশোরের ধুলো বালি মাখা নানা স্মৃতি সম্বলিত তুলসী লাহিড়ীর সেই আদি নিবাসটি অযত্নে অবহেলায় আজ ম্লানের পথে।
তুলসী লাহিড়ীর রেখে যাওয়া দৃষ্টিনন্দন অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তবে এখন সৌন্দর্য বর্ধন বলতে তেমন কিছু নেই। বর্তমানে শুধু তার উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ, শ্বেতপাথরের কৃষ্ণমন্দিরের সুচারূপে নির্মিত নির্মাণশৈলী। যা এক সময় জমিদার বাড়ির শোভা বৃদ্ধি করতো। এছাড়া এখনো রয়েছে তুলসী লাহিড়ীর পরিবারের পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ ভগ্নদশা শয়ন ঘর, কাচারি ঘর, গোসল করার গভীর কুয়া( ইন্দিরা) ও পূজা অর্চনার জন্য নির্মিত একটি উপসানলয়। এ সব নিদর্শন কেবল সংস্কার ও মেরামতের অভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় তুলসী লাহিড়ী পরিবারের সাজানো গোছানো স্মৃতি চিহ্নগুলো দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে এক সময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে ঐতিহাসিক নিদর্শন এই বাড়িটির দিকে এখন আর খুব বেশি পর্যটক আসেন না। বিশেষ করে জমিদার বাড়িটির বেহালদশার কারণে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কাছে দেশবরেণ্যে নাট্যাভিনেতা তুলসী লাহিড়ীর ইতিহাস ঐতিহ্য অজানাই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তুলসী লাহিড়ীর জীবন ইতিহাস থেকে জানা যায়, রংপুরের গ্রামীণ কাহিনী, জনজীবনের দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও বহুবিধ সমস্যা বাস্তব সত্যের স্পর্শে জীবন্ত করে ফুটে তুলতেন তিনি তার নির্মিত নাটকগুলোতে। রংপুরের লোকমুখের ভাষায় ‘ছেঁড়াতার’ ও ‘দুঃখীর ইমান’ নাটক দুটি রচনা করে তিনি অসামান্য খ্যাতি লাভ করেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় রংপুর জেলার গ্রাম্য কৃষক সমাজের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি রচনা করেছেন ‘ছেঁড়াতার’ নাটকটি। একটি বিশেষ পরিবারের দুঃখ ও বেদনার কাহিনী ‘ছেঁড়াতার’ নাটকের মুখ্য ও বর্ণনীয় বিষয়। তার ‘দুঃখীর ইমান’ নাটকটিও রচিত হয়েছে পঞ্চাশের মহান্বস্তরের পটভূমিকায়। ‘ছেঁড়াতার’ ও ‘দুঃখীর ইমান’ নাটক দুটিতে গ্রামীণ পরিবেশের সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্রাঙ্কন সার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন।
বহুরূপী সম্প্রদায় অভিনীত ‘ছেঁড়াতার’ নাটক মঞ্চায়ন করে কলকাতার রঙ্গমঞ্চে বিশেষ সংবর্ধিত হয়েছিলেন তিনি। তুলসী লাহিড়ী যে সময় চিত্রজগতে পদার্পণ করেন তখন ছিলো চলচ্চিত্রের অন্ধকার যুগ। ক্রমেই মঞ্চ নাটক ও সিনেমায় দিন বদল হয় এবং তিনি পঞ্চাশটির অধিক ছবিতে অভিনয় করেন।
এছাড়া তাঁর অসাধারণ নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘মায়ের দাবি’ (১৯৪১ খ্রি:) ‘পথিক’ (১৯৫১ খ্রি:), ‘লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার’ (১৯৫৯ খ্রি:) ‘মনিকাঞ্চন’, ‘মায়া কাজল’, ‘চোরাবালি’, ‘সর্বহারা’ প্রভৃতি। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসাড়তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি নাটকগুলি রচনা করেন।
তুলসী লাহিড়ীর ভাই গোপাল লাহিড়ী ছিলেন একজন ভারত-বিখ্যাত ক্ল্যারিওনেট বাদক। যে চাকরকে গোপাল লাহিড়ী বন্ধুক চালানো শিখিয়েছিলেন, সেই চাকরের গুলিতেই তিনি প্রাণ হারান মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। নলডাঙ্গার জমিদার বংশের এক বিখ্যাত কবির নাম শ্রী গোবিন্দ কেলীমুন্সি। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন ‘সুধার আকর’ এবং ‘সংক্ষিপ্ত ভগবত।
তিনি ছিলেন বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার। তার নাটক রচনা ও অভিনয় দিয়ে খুব অল্প সময়ে হয়ে ওঠেন বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার। তার রচিত নাটক ও অভিনয়ের কলাকৌশলের কারণে তৎকালীন নাট্য আন্দোলনে এক নব দিগন্তের উন্মোচন হয়েছিল। প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী, গীতিকার, সুরকার তুলসী লাহিড়ী একাধারে বি.এ. ও বি.এল. পাস করে তিনি প্রথমে রংপুর শহরে ও পরে কলকাতার আলিপুর কোর্টে আইন পেশায় যোগদান করেন।
এ সময় তাঁর রচিত দুটি গান জমিরউদ্দিন খাঁ রেকর্ড করলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। এর ফলে হিজ মাস্টার্স ভয়েস ও মেগাফোন গ্রামোফোন কোম্পানিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালকের পদ লাভ করেন। এর মধ্যে তিনি আইন ব্যবসা ত্যাগ করে চলচ্চিত্র ও নাট্যাভিনয়ে যোগ দেন এবং ক্রমে মঞ্চাভিনেতা, চিত্রাভিনেতা, গীতিকার, নাট্যকার ও চিত্রপরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৫৯ সালের ২২শে জুন মাত্র ৬২ বছর বয়সে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কিংবদন্তি এই তুলসী লাহিড়ীর জীবনাবসান ঘটে কলকাতায়।
বর্তমানে তুলসী লাহিড়ীর জমিদার বাড়িটিতে বসবাস করছেন তুলসী লাহিড়ীর একমাত্র নাতি তন্ময় চন্দ্র, তার স্ত্রী শিলারাণী, ছেলে তৌসিক, তুষার ও মেয়ে সুনান্দরাণী। বর্তমানে তুলসী লাহিড়ীর বসত ঘরটিসহ মন্দির, কুয়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ গুলো কৃত্রিম উপায়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে পরিবারটি।
এ ব্যাপারে তুলসী লাহিড়ীর নাতি তন্ময় চন্দ্রের ছেলে তৌসিক নয়া শতাব্দীকে জানান, 'উপমহাদেশের মধ্যে বিখ্যাত এমন একজন ব্যক্তি তুলসী লাহিড়ী। তিনি তার এই জমিদার বাড়িতেই সংস্কৃতি চর্চা করতেন। সংস্কারের অভাবে ঐতিহাসিক এই নিদর্শন গুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করলে এটি একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে। আর পর্যটন কেন্দ্র হলে সরকার যেমন রাজস্ব পাবে তেমনি আগামী প্রজন্ম ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে''।
স্থানীয় সাংবাদিক তোফায়েল হোসেন ক্ষুব্ধতার সঙ্গে বলেন, 'তুলসী লাহিড়ীর স্মৃতি সরণীয় করে রাখার জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন সংস্থা আজও ব্যবস্থা নেয়নি। আমরাই শুধু মাঝে সংবাদ করে তার নাম, কিছু স্মৃতি কোনো রকমভাবে জোড়া তালি দিয়ে টিকিয়ে রেখেছি। প্রাচীন স্থাপনাগুলো ক্রমান্বয়ে ভেঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনেক সাংবাদিক ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নিয়ে যান। এ নিয়ে টেলিভিশন ও পত্রিকায় একাধিক বার খবরও প্রকাশিত হয়েছে। তবুও তুলসী লাহিড়ীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এখন অবধি কোন বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায়নি।
নলডাঙ্গা ইউনিয়নের স্থানীয় সচেতন বাসিন্দারা জানান, 'সংস্কার ও মেরামতের অভাবে অবহেলিত জমিদার বাড়িটির অনেক পুরানো স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনতিবিলম্বে তুলসী লাহিড়ীর জন্মভূমি জমিদার বাড়িটির হারানো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। এই জমিদার বাড়িটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িত'।
সাদুল্যাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান সাহারিয়া খাঁন বিপ্লব আক্ষেপ করে বলেন, 'তৎকালীন সময়ের কীর্তিমান দেশ বরেণ্যে ব্যক্তিটিকে নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। দেখবেন হয়তো কোনো একদিন সঙ্গীত জগতের আলোড়ন সৃষ্টিকারী জনপ্রিয় তুলসী লাহিড়ীর নামটি ইতিহাস থেকে মুছে যাবে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তুলসী লাহিড়ীর ঐতিহাসিক নিদর্শন টিকিয়ে রাখা সম্ভব'।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ