গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন মিষ্টি তৈরীর উপাদানের কথা আসলেই যে নামগুলো আসে তা হল দুধ থেকে তৈরী ক্রিম, ছানা আর ঘি। এগুলোর অধিকাংশই পাওয়া যায় মহিষের দুধ থেকে। পাশাপাশি মহিষের মাংসের কদর তো রয়েছেই।
এছাড়া কৃষকদের উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষি ফসল গাড়ি দিয়ে টানার শক্তিশালী প্রাণীও মহিষ। এক সময় রাস্তায় বের হলেই নজরে পরতো ওই মহিষের টানা গাড়ি। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ওইসব গাড়ি খুব একটা চোখে না পড়লেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে বেড়েছে মানুষের মাংস আর মিষ্টির চাহিদা। এই চাহিদার বড় অংশ প্রতিনিয়ত মেটাচ্ছে মহিষ খামারীরা।
নাটোর জেলায় এখন এই মহিষের খামার ৬১১টি। ওই খামারগুলো কৃষকরা লাভজনকভাবে পালন করছে মহিষ।
তবে একসময় নদী ও চর এলাকা ছাড়াও পরিত্যক্ত জমিতে খোলা ভাবে পালন হত মহিষ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় কমেছে ওইসব চারণ ভূমি। ফলে এখন খামার করেই পালন করা হচ্ছে মহিষগুলো। এতে মহিষের খাবার যোগারে বাড়তি টাকা ব্যায় হলেও দুধসহ দূগ্ধজাত সামগ্রীর দামও বেড়েছে। ফলে মহিষের খামার এখনও লাভজনক বিধায় ওই মহিষ পালনকে কেন্দ্র করে চলছে কয়েক স্তরের জীবন যাপন আর ব্যাবসা যা আমাদের অর্থনীতির ওপর ফেলছে ব্যাপক প্রভাব।নাটোর জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা, ডাক্তার গোলাম মোস্তফা বলেন, নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়াসহ সকল উপজেলাতেই পালন করা হচ্ছে মহিষ। তবে সবচেয়ে বেশি মহিষ পালন করা হয় লালপুর উপজেলার বিভিন্ন চর আর পদ্মা নদীর পাড় সংলগ্ন গ্রামে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, জেলায় মোট ৬১১টি মহিষের খামার রয়েছে। মোট মহিষের সংখ্যা ৭ হাজার ২৪৮টি। এরমধ্যে লালপুর উপজেলায় সর্বোচ্চ খামার ৩৮০টি। ওই উপজেলায় পালন করা মোট মহিষের সংখ্যা ৫হাজার ৫০৮টি। জেলায় পালিত মহিষের মধ্যে দেশীয় প্রজাতীর বাইরে রয়েছে ভারতীয় মুরা(Murra) জাত।সরেজমিনে লালপুর উপজেলার আড়ানী বাকনা চরে দেখা মেলে মহিষের খামার। স্থানীয় খামারীরা জানালেন, ওই চরেই রয়েছে ১৫টি খামার। যেখানে পালন করা হচ্ছে প্রায় ৩শ’ টি মহিষ।
কথা হলো মহিষ খামারী শিমুলের সাথে। তার খামারে রয়েছে ১০টি মহিষ। এরমধ্যে দুধ দিচ্ছে ৬টি।
খামারী শিমুল বলেন, ৬টির প্রতিটি মহিষ থেকে প্রতিদিন তিনি ৫-৭ লিটার দুধ পান। তিনি ওই দুধ পাশের ঘোষদের কাছে বিক্রি করেন। দুধ পরীক্ষা করে কি পরিমাণ ক্রিম রয়েছে তার ওপর তিনি দাম পান দাবি করে বলেন, প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে তিনি ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকা পান। দুধের বাইরে অনেকে মাংস বিক্রির জন্য মহিষ কিনে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, মহিষগুলো পালন করে যাবতীয় খরচ বাদে তার প্রতিবছর ২ লাখ টাকা লাভ। তবে মহিষ পালনের খরচ কমানো গেলে বা দুধ আরো বেশি হলে তাদের লাভ আরো বেশি হতো।
এব্যাপারে জানতে চাইলে দুধ ক্রেতা উপজেলার নাগশোষা এলাকার পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ওই এলাকায় মোট ৪ জন ঘোষ রয়েছেন তারা। প্রতিদিন স্থানীয় মহিষ খামারীদের কাছ থেকে দুধ কিনে ক্রিম, ছানা ও ঘি তৈরী করে বিক্রি করেন। ক্রিম তৈরীর মেশিন তাদের নিজেদের রয়েছে। বাপ-দাদাদের আমল থেকে তারা ওই ব্যবসায় জড়িত।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাধারণত ১ কেজি মহিষের দুধে ১৫০ গ্রাম ক্রিম পেলে তার দাম পরিশোধ করেন ৭০ টাকা। ক্রিম ছাড়া দুধের পাতলা অংশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তারা ছানা তৈরী করেন।
তারা প্রতিদিন ১০-১২ কেজি ক্রিম তৈরী করেন জানিয়ে আরো বলেন, ১ কেজি ক্রিম থেকে ৪৫০ গ্রাম ঘি তৈরী হয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেলা ও জেলার বাইরে থেকে মিষ্টি দোকানীরা তাদের কাছ থেকে ছানা কিনে নিয়ে যায়। ওই ছানা দিয়ে রসগোল্লা, চমচম, কাঁচাগোল্লাসহ নানা মিষ্টি তৈরী হয়। এছাড়া ঘি ব্যাবসায়ীরাও তাদের কাছ থেকে ক্রিম কিনে নিয়ে যান।
তিনি বলেন, প্রতি কেজি ঘি তারা পাইকারী ৮শ’ প্রতি কেজি ক্রিম ৩শ’ ও প্রতি কেজি ছানা বিক্রি করেন ১শ’ টাকায়। সারা বছর ব্যবসা করে সংসার ভালোভাবেই চলে এমন দাবি করেন তিনি।
মহিষের জাত উন্নয়ন বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, মহিষের জাত উন্নয়নের কাজ চলছে। ভারতীয় জাতের সাথে দেশীয় জাতের মিশ্রণে জাত উন্নয়ন করা গেলে দুধের পরিমাণ বাড়বে। এতে খামারীরা যেমন আরো লাভবান হবেন তেমনি নতুন নতুন খামারী তৈরী হবে। আর এটা হলে স্থানীয় মাংস, দুধ, ক্রিম, ছানা ও ঘি এর চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ অন্য জেলায় বিক্রি করা যাবে। আর এটা করা গেলে তা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
তিনি আরো বলেন, ওই কৃত্রিম প্রজননের কাজ বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুরে চলছে। দ্রুতই লালপুর উপজেলায় শুরু হবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ