বসতভিটার কিছু দূরেই ফসলি জমি। নদীর দু’পাড়ের মাঠে সবজির সমারোহ। চাষ করা হয়েছে আলু, মরিচ ও বেগুনসহ বিভিন্ন জাতের সবজি। এসব ক্ষেতের পাশেই অনেক জমি ৮/১০ ফুট নিচু। সেখান থেকে স্কেবেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটা ও বিভিন্ন স্থাপনা ভরাটের কাজে। এই চিত্র কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের পূর্ব মুক্তারকুল এলাকার।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, কৃষি জমি সুরক্ষা আইনের তোয়াক্কা না করে ফসলি জমির মাটি বিক্রির স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা ফসলি জমি ও নদীর পাড় থেকে বালু-মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছে। গ্রামের নদীর পাড়ের কয়েক অন্ততপক্ষে ৫০ একর জমি রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় কয়েক একর জমি থেকে বালু-মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। জমির কয়েকজন মালিকদের অল্প কিছু টাকা দিয়ে জোরজবরদস্তি করে মাটি কাটা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে মারধর ও হয়রানির শিকার হচ্ছে গ্রামবাসী। তারা বলছেন, জোরপূর্বক ফসলি জমি থেকে গভীরভাবে খনন করে মাটি ও বালু উত্তোলন করায় আশপাশের জমি ভেঙে পড়ছে। কৃষকরা সব সময় আতঙ্কে থাকেন কখন কার জমি ভেঙে পাশের গর্তে পড়ে।
ভুক্তভোগীরা বলেন, সব মহলকে ম্যানেজ করেই ফসলি জমি থেকে মাটি-বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে জোর প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন চক্রটি। তাই ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। তারা এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ফসলি জমির বুক চিরে ছুটছে ডাম্পার (মিনিট্রাক) পর ডাম্পার। লক্ষ্য ফসলি জমি থেকে কাটা মাটি ইট ভাটায় নিয়ে আসা। সামান্য অদূরেই চলছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঝ খান থেকে অত্যাধুনিক স্কেবেটর দিয়ে জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ। সে মাটি সংগ্রহে ব্যস্ত অসংখ্য ডাম্পার। যেই জমির উপরিভাগে সবজী এবং ধান বুনা হতো সে জমিতে এখন বিশাল আকারের গর্ত। ওই গ্রামের চারপাশ ঘুরে দেখা যায় এ এক অন্যরকম কর্মব্যস্ততা। এভাবেই পূর্ব মুক্তারকুলের বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির বালু ও মাটি যাচ্ছে ইটভাটার পেটে। এতে করে ওই জমিগুলো যেমন উর্বরতা হারাচ্ছে তেমনি ধ্বংস হচ্ছে এসব ফসলি জমি। দেশের আইন অনুযায়ী ইটভাটার জন্য কৃষি জমি থেকে মাটি সংগ্রহ নিষিদ্ধ হলেও তার কোনো তোয়াক্কা করছে না বেশিরভাগ ইটভাটার মালিকরা। পরিবেশ অধিদপ্তর আইন লঙ্ঘনকারী ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে ফসলি জমি ধ্বংসের মহোৎসব হরহামেশাই চোখে পড়ছে।
এ সময় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা করিম, সোলায়মান আলীসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। তারা বলেন, ফসলি জমির প্রথমে মাটি কাটা হলো। এখন স্কেবেটর দিয়ে বেড়িবাঁধসহ নদীর পাড়ের মাটি কাটা হচ্ছে। ফলে জমির তলদেশ ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় আমাদের আশপাশের জমিগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া মাটি-বালু পরিবহনের কাজে ভারি যান (ডাম্পার-ট্রাক) চলাচলের কারণে ধুলো পড়ে পুরো মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই এলাকার ছলিম, হাবিবুল্লাহ, জয়নাল, বেদার ও স্কেবেটর মালিক ফয়েজসহ স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র অবাধে বালু-মাটি কাটছেন। শুধু তাই নয়, নদীর তীর থেকে এক্সকেভেটর মেশিন দিয়ে মাটি কেটে ডাম্পার যোগে ইটভাটাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছেন। নির্বিচারে চলছে ফসলি জমির উপর অত্যাচার। এমনকি এই চক্রটি নিজেদের সুবিধার জন্য সরকারি খাস জমির মাটিও বিক্রি করে যাচ্ছে সমান তালে। এ যেন স্বেচ্ছাচারিতার রাজত্ব। এতে একদিকে যেমন ফসলি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব এবং ঘরবাড়ি, নদীর বেড়িবাঁধ হুমকিতে পড়েছে। মাটিখেকোরা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের এই অপকর্মে বাধা দিতে সাহস পাচ্ছে না।
একই গ্রামের ভুক্তভোগী শামশুল আলম বলেন, খননযন্ত্র দিয়ে ফসলি জমি, নদীর পাড়ের মাটি কেটে ডাম্পার দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কলঘর এলাকার ফয়েজসহ স্থানীয় ছলিম গং। এ বিষয়ে অভিযোগ করলেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা।
নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, প্রভাবশালী মাটি ও বালু ব্যবসায়ীরা অনুরোধ সত্ত্বেও বালু ও মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছেন। সারা রাত ডাম্পারে মাটি ও বালু পরিবহন করায় গ্রামীণ সড়কগুলো ধসে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। আবার নদীর পাড়ের মাটি কাটার কারণে বেড়িবাঁধসহ নদীর তীরবর্তী ফসলি জমি ও বাড়িঘর হুমকির মুখে পড়েছে।
তারা আরও বলেন, প্রভাবশালী বালু ও মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগ করে প্রতিকার মেলেনি। উল্টো স্থানীয় ইউপি সদস্য নাছির উদ্দিন নিজেই ড্রেজার দিয়ে অবৈধ বালু ব্যবসায় মেতে উঠেছেন। মাঝে মাঝে প্রশাসন থেকে অভিযান চালিয়ে মেশিনপত্র জব্দ করা হলেও কিছুদিন পর আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। এ অবস্থা বিরাজ করলে আগামী দু’তিন বছরের মধ্যে নদীর পাশের ফসলি জমি, ভিটে ও বাড়িঘর ধসে নদগর্ভে বিলীন হবে।
স্থানীয় কৃষক হারুন উর রশিদ বলেন, কৃষকদের বাঁধা উপেক্ষা করে এই চক্রটি কৃষি জমি, বেড়িবাঁধের মাটি অবাধে কেটে নিচ্ছে। এতে করে ধুলা বালিতে আশপাশের শত শত একর ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন রায় বলেন, বিভিন্ন এলাকায় একাধিকবার অভিযান চালিয়ে স্কেবেটর-ডাম্পার আটকসহ ডেজার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফসলি জমিসহ নদীর পাড় কাটার বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ