মাঝিদের (বন্দরের শ্রমিক) হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে টেকনাফের একমাত্র স্থলবন্দর। তাদের কথা ছাড়া বন্দরে কোনো মালামাল লোড-আনলোড হয় না। চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা পেলে তবেই হয় পণ্য খালাস। এভাবে প্রতিদিন অন্তত শতাধিক ট্রাক থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। নেতৃত্বে রয়েছে আজগর নামের এক মাঝি। আর প্রতিদিনের কাঁচা টাকায় তিনি নির্মাণ করেছেন আলীশান বাড়ি, কিনেছেন লেটেস্ট মডেলের গাড়ি। চলাফেরা করেন দেহরক্ষী নিয়ে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি টেকনাফ স্থলবন্দর পরিদর্শন শেষে অতিরিক্ত বাণিজ্য সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পরিবহন ও শ্রমিক সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বন্দর। তারা বাড়তি টাকা নেয়ার কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান করা হবে।
তিনি জানান, একজন ব্যক্তির হাতে টেকনাফ স্থলবন্দরে শ্রমিকদের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। তাও পাঁচ-ছয় বছর এই ব্যক্তিই শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ ও মজুরির ব্যবসা করছে। এখন এটা ওপেন টেন্ডার হওয়া দরকার। এ ছাড়া টেকনাফ স্থলবন্দর থেকে ঢাকা পর্যন্ত পণ্যবোঝাই একটি ট্রাকের ভাড়া ৪০ হাজার টাকারও বেশি নেয়া হচ্ছে। এটি কোনো মতেই কাম্য নয়। এছাড়া ব্যবসায়ীদের ঘাটে ঘাটে নানা চাঁদা দিতে হয় বিভিন্ন সিন্ডিকেটকে। যে কারণে পেঁয়াজসহ আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের এক মাত্র স্থল বন্দরটি স্থানীয় মাঝিদের দখলে রয়েছে যুগ যুগ ধরে। নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা মালামালের লোডিং আনলোডিং এর সম্পূর্ণ খরচ সিএন্ডএফ-কে দিয়ে দেন। এরপর সেখান থেকে শ্রমিকদের টাকা দেয়া হয়; কিন্তু এসব নিয়মের তোয়াক্কা করেন না বন্দরের শ্রমিকরা। তারা বাড়তি টাকা না পেলে কোনো মালামালই খালাস করেন না।
আওয়ামী লীগের টেকনাফ পৌর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী আব্দুর শুক্কুর বলেন, টেকনাফ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ ও লেবার মাঝিরা সীমাহীন দুর্নীতি করছে। ব্যবসায়ীরা মালামালের লোডিং আনলোডিং এর সম্পূর্ণ খরচ সিএন্ডএফ-কে দিয়ে দেন। লেবারের অতিরিক্ত টাকা চার্জ করার কারণে, ব্যবসায়ীদের সিএন্ডএফ খরচও বেশী হয়। চলতি বছরের জুলাই মাসে আমার ব্যক্তিগত ১৫টি পিয়াজের গাড়ী থেকে ৮৫০০ টাকা করে অতিরিক্ত নেয়া হয়। অথচ মালামাল লোডিং আনলোডিং এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব বন্দর কর্তৃপক্ষের।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে বন্দর ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি লেবারের সম্পূর্ণ টাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে বলে জানান। এরপর বন্দরের লেবারের মাঝিকে জানালে তারা বলেন বন্দর কর্তৃপক্ষের টাকায় আমাদের চা খাওয়ার পয়সাও হয় না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করার পরে বন্দর কর্তৃপক্ষ মজুরি হিসাবে জনপ্রতি ২৬০ টাকা করে দেয়। অথচ প্রতি গাড়ি থেকে মাঝি সর্দাররা আদায় করেন ৮৫০০ থেকে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপর সেখান থেকে লেবারদেরকে দেয়া হয় গাড়িপ্রতি মাত্র ৩ হাজার টাকা। এভাবে বন্দরে দৈনিক ১২০ থেকে ১৫০টি গাড়ি হলে লোড-আনলোড হলে কি পরিমাণ টাকা মাঝিদের পকেটে যায় সেটা চিন্তার বিষয়। একই কথা জানিয়ে নাসীর নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, জুলাই মাসে ১৪৫ ব্যাগ শুটকি খালাসের জন্য তাকে বাড়তি ৮৫০০ ও লেবারদের আলাদা ৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। বাড়তি টাকা না দেয়ায় দুইদিন ধরে তার শুটকি ফেলে রাখা হয়। এতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে মাঝিদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কাঠ ব্যবসায়ী জানান, ইচ্ছা করেই বন্দরের দুটি জেটিতে কাঠ বোঝাই নৌকা ভিড়তে দেয়া হয় না। এ কারণে কাঠগুলো একটু দুরে পানিতে ফেলা হয়। এরপর সেখান থেকে মাঝিদের দিয়ে টেনে তীরে আনার পর ট্রাক লোড করা হয়। বন্দরে ক্রেন না থাকার কারণে মাঝিরা এই সুযোগ কাজে লাগায়। এজন্য তারা নিয়মের বাইরে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বাড়তি দাবি করে। টাকা না দিলে কাঠগুলো পানিতেই ফেলে রাখা হয়। এতে মূল্যবান কাঠ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মাঝিদের বাড়তি টাকার দাবি মেনে নিতে সবাই বাধ্য হয়। একই ধরনের অভিযোগ করেন অন্য ব্যবসায়ীরাও।
জানতে চাইলে সিএন্ডএফ এজেন্ট সমিতির সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন, আমরা সকল ব্যবসায়ী বন্দরের কাছে জিম্মি। বিশেষ করে মাঝিদের কাছে। প্রতিবাদ করলেই লোড-আনলোড বন্ধ করে দেয়। আবার বাড়তি টাকা না দিলেও পণ্যের গায়ে হাত দেয় না।
জানা গেছে, এ সব অপকর্মের মূল হোতা হচ্ছেন আজগর মাঝি। গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। সে শ্রমিক হিসাবে টেকনাফ স্থল বন্দরে ২০০২ সালের দিকে যোগদান করেন। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যবসায়ীদের এভাবে জিম্মি করে হয়ে গেছেন কোটিপতি। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, তার রয়েছে তিনটি বিলাস বহুল বাড়ি, নিজ জেলা পিরোজপুরে একটি, কক্সবাজারে একটি ও টেকনাফ সদরের কেরুনতলী গ্রামে একটি। বর্তমানে তিনি তার ছোট ভাই ও তার স্ত্রী কেরুনতলীর ভোটার। রয়েছে একটি গাড়ী ও নিজস্ব ড্রাইভার। দুই জন দেহরক্ষী ও ২ জন কেরানি নিয়ে সব সময় চলাফেরা করেন। নিজেকে শ্রমিকলীগ নেতাও পরিচয় দেন। আজগরের অন্যতম সহযোগী হচ্ছেন মো. আলম। সে পুরাতন রোহিঙ্গা। তার বাড়ি হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা ৮ নং ওয়ার্ডে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আজগর মাঝি নয়া শতাব্দীকে জানান, ব্যবসায়ীরা তাকে অতিরিক্ত টাকা দেয় কেন? কারো কাছ থেকে জুলুম করে টাকা নেয়া হয় না। খুশি হয়েই ব্যবসায়ীরা তাকে আগে-ভাগে পণ্য খালাস করার জন্য টাকা দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে কাঠ বোঝাই কার্গো আসার পর সেগুলো পানিতে ফেলে দেয়া হয়। এরপর নিয়ম অনুযায়ী বন্দরের ক্রেন দিয়ে তা ট্রাকে লোড করার কথা। কিন্তু ক্রেন না থাকার কারণে সেগুলো শ্রমিকরা কাধে নিয়ে ট্রাকে লোড করেন। এজন্য ব্যবসায়ীরা বাড়তি খচর দেয়। আবার শুটকি ও মাছ বোঝাই ট্রলার আসার পর দ্রুত তা ট্রাকে লোড করে দেয়ার জন্য বকশিস দেয়। সবাই আগেভাগে মাল লোড করে দিতে বলেন। এ কারণে বাড়তি কিছু টাকা সবাই খুশি হয়েই দেন। এ বিষয়ে সচিবকে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। বাড়ি ও গাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, সারাজীবন পরিশ্রম করে বাড়িগুলো তিনি বানিয়েছেন। এ ছাড়া অসুস্থতার জন্য একটি ভাড়া গাড়িতে তিনি সব সময় চলাফেরা করেন। এটাকে ব্যবসায়ীরা অতিরঞ্জিত করে চাউর করছে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ