ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

অব্যবস্থাপনায় মুখথুবড়ে পড়েছে কক্সবাজারের পর্যটন!

প্রকাশনার সময়: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৫৫

দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের প্রতিটি সেক্টরেই বিরাজ করছে নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতি। অব্যবস্থাপনার যাতাকলে পড়ে ধুকছে অর্থনীতির চাকা সচলকারী অন্যতম এই খাতটি। জেলা প্রশাসন, বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি, পর্যটন পুলিশসহ এধরণের আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সক্রিয় উপস্থিতি দেখা গেলেও আজও শৃঙ্খলা ফেরেনি কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে। বছরজুড়েই নেতিবাচক আলোচনায় শিরোনাম হতে থাকে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটি।

জানা গেছে, সড়ক ব্যবস্থার নাজুক পরিস্থিতি, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনার স্তুপ, অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, অনিরাপদ সমুদ্রস্নান ও প্রাণহানীসহ রয়েছে হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতে পর্যটকদের সাথে কর্মকর্তা কর্মচারীদের অশোভন আচরণ।

ভোরের আলো না ফুটতেই দালাল ফাঁড়িয়াদের উপদ্রব, এর উপর পর্যটন এলাকায় চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনা তো নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও আছে সৈকতে ফটোগ্রাফার, ঘোড়সওয়ারী ও বীচবাইক ব্যবসায়ীদের গলাকাটা বাণিজ্যের যন্ত্রণা। ফলে নানাবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে পর্যটন এলাকা ত্যাগ করেন বেশিরভাগই পর্যটক।

সম্প্রতি কক্সবাজার বেড়াতে এসে দেশের অন্যতম কৌতুক অভিনেতা আরমান তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের আইডি থেকে পোস্ট করে জানান। বলেন- পর্যটন শহরে কোনো ভালো রেস্টুরেন্ট নেই। যা আছে সবখানেই গলাকাটা বাণিজ্য চলছে। অতিনিম্ন মানের খাবার সরবরাহ করে হাতিয়ে নিচ্ছে পর্যটকদের টাকাগুলো। এতে তিনি শালিক নামে একটি রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে খুবই নিন্ম মানের খাবারের বিনিময়ে চড়া মূল্য পরিশোধের কথা উল্লেখ করে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি। এর আগে তারকা মানের হোটেল বেস্টওয়েস্টার্নের বিরুদ্ধে অশোভন আচরণ ও ভাউচার বহির্ভূত অর্থ আদায়ের অভিযোগ করেন ঢাকা থেকে স্বপরিবারে আগত পর্যটক ড. শাহীন। সে সময় বিষয়টি জেলা পর্যটন সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মুরাদের কাছে অবহিত করা হলে ঘটনার সত্যতাও পাওয়া যায়।

তবে এক্ষেত্রে রয়েছে কিছুটা ব্যাতিক্রমও। হাতেগুনা কয়েকটি হোটেল-রেস্টুরেন্ট তাদের মান ধরে রেখেছে। সর্বোচ্চ আতিথেয়তা দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে পর্যটকদের। এব্যাপারে কলাতলী হোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও রেইনভিউ হোটেলের স্বত্বাধিকারী মুকিম খান প্রতিবেদককে জানান- পেশাদার পর্যটন ব্যবসায়ীরা সব সময় চায় পর্যটকদের সাথে পর্যটক বান্ধব আচরণ করে জেলার পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু কতিপয় অসৎ মানসিকতার ব্যবসায়ী রাতারাতি বড়লোক হতে চায়।

এবং পর্যটকদের সেবার ব্যাপারেও একেবারেই উদাসীন থাকে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে পুরো পর্যটন শিল্পের উপরে। ফলে ভালো মন্দ সবাইকে এক কাতারে ফেলে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এব্যাপারে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রয়োজনে পাশে থেকে সহযোগীতার আশ্বাসও দেন তিনি।

পর্যটন ব্যবসায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও ব্যক্তিত্ব মো. লোকমান হোসাইন অপু রয়েছেন তারকা মানের হোটেল দ্যা কক্সটুডের ম্যানেজার হিসেবে। দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশ তিনি ভ্রমণ করেছেন। রয়েছে কাজের অভিজ্ঞতাও। অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন- পৃথিবীর সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী পর্যটন কেন্দ্র হলো বাংলাদেশের কক্সবাজার। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো যদি একটি বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে কক্সবাজারের পর্যটনকে সাজায় কিংবা এগিয়ে নেয় নিকটতম সময়ে কক্সবাজার হবে বিশ্বের সর্বাধুনিক এবং শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র। যার মাধ্যমে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হবে।

কলাতলীস্থ নাম করা রেষ্টুরেন্ট পউষীর স্বত্বাধিকারী মো. আবু বক্বর জানান- অনেক সম্ভাবনা তৈরি হবার পরও কিছু সংকট এখনও রয়ে গেছে। যেমন- পর্যটন শহরটাকে ময়লা আবর্জনা মুক্ত রাখা জরুরী। প্রয়োজনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পরিবেশ বান্ধব ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে। সেই সাথে দালাল ফাঁড়িয়াদের উপদ্রবও শক্ত হাতে দমন করতে হবে। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীদের দালাল নির্ভর তৎপরতার কারণে সৎ ব্যবসায়ীদের সুনান ক্ষুন্ন হচ্ছে। বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে হবে।

এদিকে দীর্ঘ এক বছরের করোনা পরিস্থিতির কারণে মৃতপ্রায় পর্যটন এখন নতুন করে সতেজ হতে শুরু করেছে। এছাড়াও অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়টাকে পর্যটনের সোনালী মৌসুমও বলা হয়ে থাকে। এসময়টির মধ্যে পর্যটন নির্ভর অসাধু ব্যবসায়ী, দুর্বৃত্ত ও ছিনতাইকারীদের উপদ্রবও বৃদ্ধি পায়। এদের দমাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোর তৎপরতা ও পূর্ণ প্রস্তুতির কথা মৌখিক ভাবে শোনা গেলেও বাস্তবিক চিত্র সব সময় ভিন্ন দেখা যায়।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট দুস্কৃতিকারীদের চিহ্নিত করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর (শুক্রবার) রাত ৮টার দিকে সুগন্ধা ও সীগাল পয়েন্টের মাঝামাঝি স্থানে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন যশোরের চৌগাছা থেকে আগত পর্যটক পারভেজ ও সঙ্গীরা।

এব্যাপারে পর্যটন পুলিশের জেলা সুপার জিল্লুর রহমান মুঠোফোনে জানান- ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো যখনই ঘটছে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও দুস্কৃতিকারীদের চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযানও চালানো হচ্ছ। আশা করা হচ্ছে দ্রুতই ছিনতাইকারীদের এসব অপকর্ম বন্ধ হয়ে আসবে। আর দালালদের প্রতিরোধে প্রতিদিন সকালে ট্যুরিস্ট পুলিশের একাধিক টিম সক্রিয় ভাবে কাজ করছে। এমনকি সিভিল পোষাকেও তৎপর রয়েছে আমাদের লোকজন।

দেশের পর্যটন খাতকে আরও সমৃদ্ধশালী করতে সরকার পর্যটন কর্পোরেশনকে বিশেষ ভাবে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। কিন্তু কক্সবাজারে এই পর্যটন কর্পোরেশনের কাজ রাষ্ট্রীয় অতিথিদের হোটেল বুকিং আর আতিথেয়তাতেই সীমাবদ্ধ। পর্যটনের যাবতীয় দায়ভার কথিত বীচ ম্যানেজম্যান্ট কমিটির উপর চাপিয়ে দিয়ে দায়সারা ভাবে চলছে এই প্রতিষ্ঠান।

পর্যটকদের কাছ থেকে উঠে আসা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে কথা হলে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের কক্সবাজারের প্রধান কর্মকর্তা ও হোটেল শৈবালের ম্যানেজার মীর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন- সমন্বয় সভায় পর্যটনের যেসব সংকট সমস্যা এখনও রয়ে গেছে কিংবা নতুন ভাবে সৃষ্টি হচ্ছে সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়। সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সার্বিক পরিবেশ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো এমনটিও দাবী করেন তিনি।

এব্যাপারে পর্যটনের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবু সুফিয়ান জানান- কিছু সমস্যা সব সময় থেকে যাবে। অভিযোগও থাকবে। কিন্তু সমস্যার সমাধানে আমরা তৎপর রয়েছি কীনা সেটা দেখেন। লোকজন এখনও ধীরে ধীরে সভ্য হতে শিখছে। দালালদের মোকাবেলায় একযোগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

এজন্য প্রয়োজনে সব হোটেলকে একটি অনলাইনে ডাটাবেইজের অধীনে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। তাহলে পর্যটকবৃন্দ অনলাইনে বুকিং দিয়ে সরাসরি হোটেল বা যেকোনো পর্যটন সেবা নিতে পারবে। আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পর্যটন পুলিশ রয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন বলে মনে করেন জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ