ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

একটি মর্টার শেল ও ৭ গণকবর

প্রকাশনার সময়: ১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:১৪

গণকবরের জায়গায় স্থাপনা ক্ষুব্ধ স্বজন-সচেতনরা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সকাল ৯ টা বা তার কিছু পর। চারদিকেই অনেকটা বিজয়ের ঢামাঢুল শুরু হয়ে গেছে। আর কয়েক ঘণ্টা পর বাংলার আকাশে উড়বে যে বিজয় নিশান। পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। তাইতো রেডিওতে কান পাতছিলেন ডা. দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ। এমন সময় হঠাৎ একটি মর্টার শেল! সকল কিছু যেন উলট পালট করে দিলো। মুহূর্তে লাশের সারি। আবার কেউ আহত। তড়িগড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও কয়েকজনের মৃত্যু হয়। কিন্তু ধর্মীয় রীতি মেনে একজনকে দাহ করা হলেও শহীদ ৯ জনের মধ্যে ৭ জনেরই হয়েছে গণকবর। সাত মাসের শম্পা এন্দকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিতে। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে সিলেট নগরীর মির্জাজাঙ্গাল এলাকায়। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের সময়ে এখন অনেকটা অজানা সেই স্মৃতি। নেই গণকবরের কোন চিহ্ন। মেলেনি শহীদের স্বীকৃতিও। বরং গণকবরের জায়গায় হয়েছে বাণিজ্যিক স্থাপনা।

তাইতো ক্ষোভ শহীদ পরিবারের সন্তান শহীদ ডা. দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ’র নাতী সিলেটের রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী প্রতীক এন্দ’র। সেদিনের ইতিহাস জানতে চাইলে বিষণ্ন প্রতীক এন্দ নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমার বয়স তখন মাত্র এক বছর। আমার বাবার পার্থ শখা এন্দ’র মুখ থেকে ঘঁনাটি শুনেছি। তিনি নিজেও আহত হত হন।

প্রতীক এন্দ বলেন, আমার দাদা ডা. দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ ছিলেন সে সময়কার মিউনিসিপ্যালিটি (পৌরসভার অবসরপ্রাপ্ত) চিকিৎসক। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন মির্জাজাঙ্গাল এলাকায়। যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেটি নয়া সড়কের বিশ্বম্ভর আখঁড়ার সম্পত্তি ছলো। কিন্তু যখন মর্টার শেলটি পড়ে তখন আমার পরিবার নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন মণিপুরি রাজবাড়ীর বর্তমান ৩৪ নম্বর যে বাসায়। তখন ওই বাসায় থাকতেন আব্দুর রহমান চৌধুরী।

তিনি ছিলেন বায়না সূত্রে ওই বাসার খরিদান। পরিবারের নারী সদস্যদের কথা বিবেচনায় ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া। এবং সেখানেই মর্টারটি পড়ে। শেলের আঘাতে সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আমার দাদা ডা. দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ, তাঁর স্ত্রী সুনীতি বালা এন্দ এবং আত্মীয় প্রকৌশলী গোপেশ দাস। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকালে মারা যান ডা. দীগেন্দ্র চন্দ্র এন্দর জোষ্ঠপুত্র আমার কাকু দিব্যেন্দু এন্দ, মেয়ে শিখা এন্দ এবং দিব্যেন্দু এন্দ’র পুত্র অপু এন্দ।

তিন দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে প্রাণত্যাগ করেন ডা. দীগেন্দ্র’র আরেক মেয়ে শিবানী এন্দ এবং দিব্যেন্দু এন্দ, সাত মাসের শিশুকন্যা পম্পা এন্দ। সাতদিন পর মারা যান ডা. দীগেন্দ্রের পুত্রবধূ ও দিব্যেন্দু এন্দর স্ত্রী খনা এন্দ। পরে ধর্মীয় রীতি মেনে তাঁকে দাহ করা হয়।

অবশ্য শহীদের স্বীকৃতি না পেলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক ও শহীদ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের তালিকা নিয়ে বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ’ নামক গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ পরিবারের গল্প। বিরত্মগাথা মর্মান্তিক এ ঘটনাটি তাজুল মোহাম্মদের লেখা ‘সিলেটে গণহত্যা’ বইয়েও উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে মর্টার শেলটি কারা ছুড়েছিলো তার কোন সঠিক তথ্য মেলেনি। অনেকের ধারণা মর্টার শেলটি পাকবাহিনীকে লক্ষ্য করে মুক্তিবাহিনী ছুড়েছিলেন। যা ভুলক্রমে পড়ে এন্দ পরিবারের ওপর।

এদিকে সরেজমিনে মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় মণিপুরী রাজবাড়ীর মন্দিরের বিপরীতে যেখানে ডা. দীগেন্দ্র পরিবারের ৭ সদস্যকে সমাহিত করা হয় সেখানে গিয়ে দেখা যায় বাণিজ্যিক স্থাপনা দিয়ে জুড়া হয়েছে গণকবরের স্মৃতিময় সেই যায়গা। কোথাও নেই কোন স্মৃতি চিহ্ন।

তবে সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক ও ডা. এন্দ পরিবারের আশ্রয় দাতা আব্দুর রহমান চৌধুরীর ছেলে আব্দুল করিম কিম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ২০১১ সালে ‘নিনাই’ (নির্বিক, নান্দনিক ও ইস্পাত দৃড়) নামের একটি সংগঠন থেকে একবার এখানে সমাহিত শহীদদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানো হয়। সে সময় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এখানে উপস্থিত হয়ে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। পরে মেয়র পরিবর্তন হলে এটি আর হয়নি। বরং এর পর রাতারাতি বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি হয়েছে।

আর মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাসান মোরশেদ বলেন, মৃত্যু যাদের মর্টার শেলেই হোক সেটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। সুতরাং শহীদের স্বীকৃতি পাওয়া তাঁদের অধিকার। এমনকি এখানে একটি স্মৃতিফলক করে চিহ্নিত করা উচিৎ।

অপরদিকে ওই জায়গার মালিক বিশ্বম্ভর আখঁড়ার পরিচালক গৌতম দাস বলেন, ‘সকলকেই একটি গর্তে সমাহিত করা হয়েছে। তাই যেখানে সমাহিত করা হয়েছে সে জায়গা খালি রেখে বাকিটা স্থাপনা করা হয়েছে।’

এখানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা যায় কি না এমন প্রশ্নে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ব্যাপারটি আমার জানা নেই। যই কেউ তথ্য প্রমাণ দিয়ে আবেদন জানান তাহলে আমরা সিসিকের পক্ষ থেকে এটা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেব।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ