গ্রন্থই মানবসভ্যতার বাহন। সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র সুসংহত হয় গ্রন্থবন্ধ জ্ঞানের আলোক মশালে। এই বাস্তবতাকে শিরোধার্য করেই গড়ে ওঠা শহীদ বেলাল সাধারণ পাঠাগারের নিবেদিত প্রাণ শামছুল হক আমৃত্যু নিমজ্জিত হয়ে ছিলেন বইয়ের রাজ্যে। আর পাঠাগার ছিল তাঁর সংসার। তিনিও যেন ওমর খৈয়ামের মতো বিশ্বাস করতেন “রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলা হয়ে আসবে, বইখানি অন্তত যৌবনা”। শিক্ষা জগতের গভীরে প্রবেশ করার জন্য একটি নয়, হাজারো বই দিয়া সাকোঁর বদলে সেতু নির্মাণ করেছিলেন শামছুল হক। স্তূপাকার বইয়ের পার্শ্বে এক কোনে স্বল্প পরিসরে এই পরিশ্রমী ব্যক্তিটি রাত যাপন করতেন।তিনি অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহাড়া দিয়ে আগলে রেখেছিলেন শহীদ বেলাল পাঠাগার নামে একটি সাধারণ গ্রন্থকেন্দ্র।
এই গ্রন্থকেন্দ্রটি ১৯৬২ সালে ৩০টি বই নিয়ে গফরগাঁও পাবলিক লাইব্রেরী নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরে মুক্তিযদ্ধের সময় বেলাল আহমেদ শহীদ হলে ১৯৭২ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার পর গফরগাঁওয়ের বীরমুক্তিযোদ্ধা বেলাল আহমেদের নামে নাম করণ করা হয় ‘শহীদ বেলাল পাঠাগার’। ভরা যৌবনের ছিমছাম দেহের অধিকারী শামছুল হক শুরু থেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, থাকেন আমৃত্যু। ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি শামসুল হক ব্রেনস্টোকে মারা যান। পরে তাঁকে শহীদ বেলাল পাঠাগার আঙিনায় সমাহিত করা হয়।
তাঁর মৃত্যুর পর অব্যবস্থাপনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ৬১ বছরের পুরোনো শহীদ বেলাল পাঠাগার। যত্নের অভাবে এ পাঠাগারের ২০ হাজারের বেশি মহামূল্যবান বই ঘুন পোকা আর মরিচা ধরা আলমারিতে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সংস্কার করে গ্রন্থাগারটি আবার চালু করার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ পাঠকেরা।
জানা যায়, পাঠাগারের সামনের সড়কটি প্রশস্ত হওয়ায় লম্বালম্বিভাবে পাঠাগারের প্রধান কক্ষের অর্ধেকটা ভাঙা পড়েছে। পাঠাগারের দরজা জানাগুলোও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দুর্লভ ২০ হাজার গ্রন্থ ও পাঠাগারটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা না গেলে মৃত্যু ঘটবে আলো ছড়ানো শহীদ বেলাল পাঠাগারের।
শামছুল হক ১৯৯৪ সালে সাংবাদিকতায় ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব পদক ও ২০০৭ সালে ময়মনসিংহ জেলায় সাদা মনের মানুষ হিসেবে নির্বাচিত হন। শামছুল হক শিক্ষাজীবন শেষ করে মাত্র ২ বৎসর মাইনর স্কুলে শিক্ষকতার পর থেকেই তিনি ব্রতী হন পাঠাগার গড়ে তোলাসহ মফস্বল সাংবাদিকতার পেশায়। তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সর্বশেষ দৈনিক ইত্তেফাকের গফরগাঁওস্থ নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ শামছুল হক এর আগে দৈনিক পাকিস্থান সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় কাজ করেছেন। চিরকুমার শামছুল হকের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার কিছুই ছিল না। যৌবনেই ছেড়েছেন নিজ ঘর-বাড়ি, ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজন।
তিনি যে এক সম্ভান্ত ঘরের সন্তান ছিলেন, তা বর্তমান প্রজন্মের কেউ জানে না। তার বাবা মৌলবী মো. নাছির উদ্দিন ছিলেন বৃটিশ ভারতের অত্যাচারী জমিদার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও সংগঠক। বিপ্লবী রক্তের ধারা যার ধ্বনিতে, তিনি নেমেছিলেন জ্ঞানের মহাসমুদ্র আহরণের কাজে। সফলও হয়েছিলেন অনেকটা। তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন বইয়ের পাহাড়। পাঠাগারটিতে বর্তমানে বইয়ের সংখ্যা ২০ হাজারেরও অধিক। দুর্লভ অনেক বই ছিল তার সংগ্রহে। আছে বহু পুরনো পত্র-পত্রিকার কপি, পান্ডুলিপিসহ দুষ্পপ্রাপ্য ডকুমেন্টস। শুধু সরকারি অনুদান নয়, এসব তিনি সংগ্রহ করেছেন নিজ উদ্যোগে। হাত পেতেছেন শত শত মানুষের কাছে। লক্ষ ছিল শুধু একটাই পাঠাগার গড়ে তোলা। হাতে ৫ টাকা পেলেই তিনি ছুটে গেছেন ফুটপাতের কোথায় বই আছে তার সন্ধানে।
রাজধানী ঢাকা শহরে গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ফুটপাতের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ভান্ডার। এমনকি বিভিন্ন বাসা বাড়ি থেকে ওজনে ক্রয় করা বই তিনি সংগ্রহ করেছেন ফেরীওয়ালার কাছ থেকে। বই সংগ্রহ, পরিচর্যায় আর সাংবাদিকতায় কেটেছে তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।
শহীদ বেলাল আহমেদের ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আলাল আহমেদ বলেন, আগামী মাসে পাঠাগারের সংস্কার কাজ করবো ইনশাআল্লাহ। পাঠাগারের সামনের সড়কের নির্মাণকাজ চলায় এতদিন সংস্কার কাজ করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তাজুল ইসলাম বলেন, পাঠাগারটি সংস্কারে উদ্যোগ নেয়া হবে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ