কথিত আছে, মসজিদটি এক রাতে জ্বীনেরা তৈরী করেছিলো। অনেকে বলেন, মসজিদ আর পাশের দিঘির এক রাতে মাটির তলা থেকে উঠেছিলো। জনশ্রুতি এবং লোকমুখে শোনা যায় সাতক্ষীরা সদরের ভালুকা চাঁদপুর জামে মসজিদের এসব কথা।
প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের আগে এই মসজিদের সামনে এবং বিভিন্ন জায়গায় শতশত পানির বোতল, তেলের বোতল এবং পলিথিনে করে মাটি রেখে যান। নামাজ শেষ হলে সেগুলো নিয়ে যান মান্নতকারী ব্যক্তিরা। মসজিদের সামনের প্রাচীর ঘেষা মাটি উঠিয়ে নিয়ে গেছে অনেকে। প্রতি শুক্রবার মসজিদ সংলগ্ন মাঠে অনেকে রান্না করছেন। প্রায় সাড়ে চার শ’ বছর আগের প্রাচীন দর্শনীয় স্থান সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী ভালুকা চাঁদপুর জামে মসজিদ। এ মসজিদটির মাটি ও পানি অনেকের কাছে মহৌষধ হিসেবে বিবেচিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এখানে শুধুমাত্র মুসলিম ধর্মের মানুষ নয় সকল ধর্মের মানুষ এসে পানির বোতল, তেলের বোতল এবং পলিথিনে করে মাটি রেখে যান। নামাজ শেষ হলে নিয়ে যান সেগুলো।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় সাড়ে চার শ’ বছর আগে ভালুকা চাঁদপুর গ্রামে মানিক চৌধুরী নামে এক সিদ্ধ পুরুষ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভালুকা চাঁদপুর জমিদার বংশের সন্তান।
জনশ্রুতি আছে, এই গ্রামে খালাস সরদার নামে এক দরিদ্র ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি ছিলেন অতি পরহেজগার ও খোদাভক্ত। অলৌকিকভাবে তিনি বহু গুপ্ত সম্পদের অধিকারী হন। এ সম্পদ দিয়ে তিনি নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের নিকট থেকে তার ছেলে আজমত উল্যাহর নামে একটি জমিদারি পরগনা ক্রয় করেন। পরগনা কেনার সম্মানে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার নাম দেন আজমত উল্যাহ চৌধুরী। পরগনা কেনার পর তা রক্ষার জন্য এক শ’ বিঘা জমির চারপাশে একটি খাল খনন করেন। যা ‘গড়’ নামে পরিচিত। আকারে ছোট হওয়ায় একে গড়ের গাভীও বলা হয়। এই গড়ে ১৬ জন মাঝি নৌকায় করে দিনরাত পরগনা পাহারা দিত। কারণ সে সময় পাশের সুন্দরবনসহ বহিরাগত ডাকাতদের উপদ্রব ছিল।
জমিদার আজমত উল্যাহ চৌধুরীর ছিল ৭ ছেলে। তার মধ্যে মানিক চৌধুরী ছিলেন একজন। তিনি ছিলেন ওলিয়ে কামেল এবং বিশিষ্ট দরবেশ। জনসাধারণের নামাজের সুবিধার্থে তিনি ভালুকা চাঁদপুর গ্রামে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ২৬ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থ বিশিষ্ট এ মসজিদের দেয়াল ৪৫ ইঞ্চি পুরু। মসজিদের পাশেই আড়াই বিঘা আয়তনের কবরস্থান। মসজিদের দক্ষিণপাশে বিশাল দিঘি রয়েছে। দিঘিটির আয়তন সাড়ে চার বিঘা। সাড়ে চার শ’ বছর পরও মানুষ এ দিঘির পানি মহৌষধ হিসেবে ব্যবহার করে। তবে লোকমুকে শোনা যায় নানা ইতিহাস। কেউ বলেন, ‘মসজিদটি এক রাতে জ্বীনেরা তৈরী করেছিল।’ অনেকে বলেন, ‘মসজিদ আর পাশের দিঘীর এক রাতে উঠেছিল।’ তবে এই মসজিদটি ঘিরে অনেকে মানুষ মান্নত করেন এবং তাদের সেই মনের আশা পূরণ হলেও মসজিদে মুরগি, ছাগল, গরু, টাকাসহ বিভিন্ন জিনিস দান করেন।
মসজিদের দিঘির পানি নিতে আসা শাহানারা বেগম নামের এক নারী জানান, বিয়ের আঠারো বছর পর সন্তানের মুখ দেখেছেন তিনি। সন্তানের মুখে প্রথম ভাত দিতে পাইকগাছা থেকে ভালুকা চাঁদপুরে অবস্থিত সাড়ে চার শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদে এসেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, নিঃসন্তান থাকা কালে তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে একটি মানত করেছিলেন। আর সেটি হল-যদি তার সন্তান হয় তবে ভালুকা চাঁদপুর জামে মসজিদে মানিক চৌধুরী (রহঃ) দরগায় একটি খাসি কোরবানি দিয়ে সন্তানের মুখে ভাত দেবেন। সৃষ্টিকর্তা তার ডাক শুনেছেন। সেই সন্তানের মুখে ভাত ও খাসি কোরবানি করতে সপরিবারে এসেছেন মানিক চৌধুরী (রহঃ) দরগায়। বছর দেড়েক আগেও একাধারে কয়েক শুক্রবার এখানে এসেছিলেন তিনি। একটি বিশেষ নিয়ম মেনে মসজিদের মাটি-পানিও ব্যবহার করতেন তিনি।
সনাতন ধর্মলম্বী বিশ্বজিৎ বলেন, আমার মাসির মাথার চুলে জট পড়েছিল। সেগুলো এখানে কেটে ফেলা হয়েছে। এখান তেল ও মাটি বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই মসজিদে তেল ও মাটি রেখে গিয়েছিলাম সেগুলো নিতে এসেছি।
স্থানীয় বাসিান্দা ষাটোর্দ্ধ আনারুল সরদার বলেন, ‘মসজিদ এবং দিঘি একই রাতে হয়েছিলো বলে বয়স্কদের কাছ থেকে গল্প শুনেছি। পানি, মাটি তেল নিয়ে যায় এখান থেকে। সেরে গেলে তারা মুরগি, ছাগল অথবা গরু অথবা টাকা দিয়ে যায়। এখানে শুধু মুসলমান না অন্য ধর্মের মানুষও আসে। তারা রান্না বাড়া করে ফকির মিসকিদের খাইয়ে যায়।’
দেখা গেছে, মনের আশা যাতে পূরণ হয় সে কারণে এখানে প্রতি শুক্রবারে আসে শতশত পরিবার। এদের কেউ আসে নিঃসন্তান থেকে সন্তানের আশায়, কেউ আসে রোগমুক্তির আশায়, কেউ আসে নতুন ফসলের ভালো ফলনের আশায়। ভক্তদের আগমনে প্রতি শুক্রবার এখানে মেলা বসে। ভক্তদের কেউ আসেন মোরগ নিয়ে, কেউ আসেন ক্ষেতের প্রথম ফসলের অংশ নিয়ে, কেউ বাগানের ফল, কেউ ঘেরের প্রথম ধরা মাছ, কেউ গরু-ছাগল নিয়ে। এভাবে প্রতি শুক্রবার ভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয় ভালুকা চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ প্রাঙ্গণ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভক্তরা দিঘির পানিতে গোসল শেষে বোতলে পানি ভরে রাখছে মসজিদের সামনে। এরপর মসজিদের সামনের প্রাচীরের গোড়া থেকে মাটি নিয়ে রাখছে বোতলের পাশে। নামাজ শেষে সেই পানি-মাটি পরম ভক্তিতে ব্যবহার করছে তারা। এ দৃশ্য দু-এক বছরের নয়। এটি সাড়ে চার শ’ বছর ধরে চলছে।
মসজিদের সাবেক ইমাম ও ভালুকা চাঁদপুর মাদ্রাসার সুপার মহসীন উল ইসলাম বলেন, ‘১৯৮৪ সালে আমি এই মসজিদে যখন ইমাম হিসেবে আসি তখন মানুষ মান্নত করে থানের মতো মুরগি ছেড়ে দিয়ে যেত। স্থানীয়রা যে যা পরতো নিয়ে যেত। পরবর্তী আমি খাচা ব্যবস্থা করে মুরগি বিক্রি করে টাকা মসজিদের কাজে লাগাতাম। সেই সময় আমি দেখেছি পীর মানিক চৌধুরী (রহ:) নামে মান্নত করতো। মসজিদের উপর ইট বেধে রেখে যেতেন। আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো নামে মান্নত করা এটি শিরক। আমি মানুষকে আল্লাহর নামে মান্নত করতে বলতাম। মসজিদের পুকুর থেকে গোসল করে পানি নিয়ে আল্লাহর নামে মান্নত করে রোগ ভালো করো বা মনের আশা পূরণ করো তাহলে এই মসজিদে হাস-মুরগি, গরু-ছাগল ধান করে যান। অনেকে বাচ্চা হওয়ার পর মোরগ, ছাগল অথবা গরু জবেহ করে বাচ্চার গালে ভাত দিয়ে এখানে রান্না করে মানুষকে খাওয়া দাওয়া করান। শিরিক মুক্ত হিসেবে এটা কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম যখন মসজিটি তিনটি গম্বুজ ও তিনটি দরজা ছিলো। চুন সুড়কির গাথনি ছিলো। সেটা ছিলো ৪৫ ইঞ্জি। গম্বুজে কোন রোড নেই। ইট চুন সুরকি দিয়ে তৈরী করা। ১৯৮৩ সালের পরে সংস্কার করার হয়। ক্যাপ্টেন রবিউল ইসলাম খান মসজিদের জায়গা বৃদ্ধি করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি নিখোঁজ হন। এর পর বিভিন্ন ধর্ম প্রাণ মানুষের সহযোগিতায় মসজিদের উন্নয়ন কাজ এগিয়ে যেতে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, এই মসজিদটি মাটির তলা থেকে উঠেছে এটি সত্য নয়। তবে আমরা শুনেছি, পীর সাহেবের কেরামতীতে জ্বীনদের মাধ্যমে এই মসজিদটি তৈরী করিয়ে নিয়েছিলেন। এই দিঘি আগে নদী ছিলো। সেটা দুই পাশে বাঁধ দিয়ে দিঘী হিসেবে ব্যবহার করতেন জমিদাররা। শুনেছি তিনি ভারত থেকে এসেছিলেন।
এই মসজিদে এক সময় মসজিদে খান বাহাদুর আহসান উল্লা (রহ:) এসেছিলেন এবং তিনি বলে ছিলেন, এখানে একজন আল্লাহর বড় ওলি শুয়ে আছেন। তবে কয়েক শ’ কবরের মধ্যে ওনার কবর কোনটি সেটি তিনি দেখিয়ে দেননি। দেখিয়ে দিলে হয়তো তার কবরের মাটি পর্যন্ত রাখতো না।
মসজিদের সভাপতি জমিদার বংশের সন্তান ও অতিরিক্ত আইজিপি (এডমিন) মঈন চৌধুরীর বড় ভাই লুৎফর রহমান চৌধুরী জানান, মানিক চৌধুরী নামে একজন দরবেশ ছিলেন। তিনি এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এখানকার মসজিদের সামনের মাটি ও দিঘি পানি ব্যবহার করে মানুষ। উপকার পাওয়ার পর মানুষ দান খয়রাত করে। আমি ছোট বেলা থেকে দেখেছি মানুষ এখানে মান্নত করে মুরগি ছেড়ে দিয়ে যেত। পরবর্তীতে সেটা আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করে সেগুলো দিয়ে মসজিদের উন্নয়নকল্পে ব্যয় করে থাকি।
তিনি আরও বলেন, প্রায় সাড়ে চার শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে প্রতিদিন শত শত মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। প্রথম দিকে তিনটি গম্বুজ, ৪৫ ইঞ্চি ইট সুরকির দেওয়া ছিলো। পরর্বীতে সেটা সংস্কার করা হয়েছে। শুক্রবার এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানত আদায় ও মানত করতে দশ থেকে বারো হাজার মানুষ আসেন। বেশি আসেন নারী। মসজিদে পুরুষের পাশাপাশি পৃথকভাবে নারীদেরও নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা আছে। এখানে এক সঙ্গে দুই হাজার পুরুষ ও পাঁচশত জন নারী এক জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ