ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়

প্রকাশনার সময়: ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৩:০২

প্রায় দেড়শ বছর আগের হাজারী গুড়ের সুনাম আজো টিকিয়ে রেখেছে এ দেশের একমাত্র হাজারী গুড় উৎপাদনকারী জেলা মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজারী পরিবারসহ শতাধিক গাছী পরিবার। মানিকগঞ্জের দুটি দ্রব্যের সুনাম এক সময় এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। সে দুটি হচ্ছে তিল্লির দই ও অপরটি ঝিটকার ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়। এই গুড়ের সুনাম এক সময় এ দেশ থেকে এশিয়া, ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি ইংল্যান্ডের রানীকেও এই গুড় উপহার হিসেবে পাঠানো হত বলে লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেই শুধু খেজুরের চাষ হয়ে থাকে। এসব খেজুর গাছের দুই তৃতীয়াংশই রয়েছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায়। সেখানে প্রতি একরে ১৫টি খেজুর গাছ দেখা যায়। হরিরামপুরের ঝিটকা খেজুর গুড় শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। গুণে-মানে ও স্বাদে-গন্ধে এই গুড়ের বিস্তর সুনাম রয়েছে।

মানিকগঞ্জে শীত মৌসুমে খেজুর গাছ একটা শিল্পে পরিণত হয়। রস-গুড় উৎপাদনে পেশাদার গাছি, কুমার, কামার, জ্বালানী ব্যবসায়ী, পরিবহনের জন্য ট্রাক মালিক, চালক, ভ্যান চালক, শ্রমিক আড়তদারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ সংযুক্ত হয়ে থাকে। এই গুড় প্রথম আবিষ্কার করেছেন মিনহাজউদ্দিন হাজারী। তার নামেই এই গুড়ের নামকরণ করা হয়েছে হাজারী গুড়। হাজারী গুড়ের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দু’হাতে গুড়ো করে ফুঁ দিলে তা ছাতুর মত উড়ে যায়।

দাদার আমল থেকে গুড় উৎপাদন করে আসা গাছী আজমত আলী হাজারী (৬৫) জানান, ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই গুড় উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য সময়। আগের দিন বিকেলে গাছ কেটে হাড়ি বেঁধে দেয়া হয়। পরদিন ভোরে (সূর্য উঠার আগে) রস সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে ছেঁকে মাটির তৈরি (জালা) পাত্রে চুলায় (বাইনে) জ্বালিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় হাজারী গুড়। এই পদ্ধতি এখন আর হাজারী পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রায়ই গাছিদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। এই গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর খেতেও তেমনি সুস্বাদু। মিষ্টি ও টল টলে রস ছাড়া হাজারী গুড় হয় না। প্রতিকেজি গুড় বর্তমানে ১২’শ টাকা থেকে ১৫’শ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।

গালা গ্রামের গাছি মোমিন মোল্লা জানান, বাজারে এক ধরনের হাজারী সুদৃশ্য গুড় পাওয়া গেলেও মৌলিকভাবে তার ব্যবধান রয়েছে। এক শ্রেণীর অসাধু গুড় তৈরীকারক চিনি মিশিয়ে ও সাদা রংয়ের গুড়ের উপর নাম খোদাই করে বাজারজাত করে সাধারণ ক্রেতাদের ধোঁকা দিয়ে আসছে। ফলে হাজারী গুড়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, এই গুড় তৈরি বেশ পরিশ্রমের কাজ। প্রতি কেজি হাজারীগুড় ১২’শ-১৫’শ টাকায় বিক্রি হলেও পরিশ্রমের তুলনায় লাভ খুবই কম। গুড়ের মওসুম ৪ মাস খুবই পরিশ্রম করতে হয় আমাদের। খেজুর গাছ কাটা, হাড়ি বাঁধা ও রস সংগ্রহ করতেই বেশি সময় চলে যায়। এই সময়ে সংসারের অন্যকোন কাজ করা সম্ভব হয় না।

ঝিটকা বাজারে হাজারী গুড় বিক্রেতা মো. মনোরুদ্দিন জানান, এই বাজারে আমি প্রতিদিন ১৫-২০ কেজি হাজারী গুড় বিক্রি করে থাকি। হাজারী গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বাজারে হাজারী গুড়ের সরবরাহ নেই। বর্তমানে প্রতি কেজি হাজারী গুড় ১২’শ থেকে ১৫’শ টাকায় টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সহকারী পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান রুমেল জানান, গুড়ের মওসুমের শুরুতেই প্রতি বছর ব্যবসায়ীদের নিয়ে ঝিটকা বাজারে সভা করা হয়েছে। মানসম্মত গুড় তৈরির জন্য ও সঠিক দামে বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীদের সভায় উদ্বুদ্ধ করে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সাথে চিনি মিশ্রিত ভেজাল গুড় তৈরি না করতে তাদেরকে আল্টিমেটামও দেয়া হয়েছে। এরপরও যদি কেউ ভেজালযুক্ত হাজারী গুড় তৈরি করে তবে অভিযান নিয়মিত রেখে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মানিকগঞ্জের সুনামধন্য ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড় প্রায় বিলীন হতে চলেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার গাছ কেটে ইট ভাটায় লাকড়ি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে এবং এই গুড় শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সরকারীভাবে উদ্যোগ নিয়ে এই শিল্পকে রক্ষা করা জরুরী বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ