বৈচিত্র্যপূর্ণ ছয় ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এক একটি ঋতুর রয়েছে এক একটি বৈশিষ্ট্য। তেমনি একটি ঋতু শীত। হেমন্তের পরেই এই ঋতুর দেখা মিলে। এই শীত কালেই পাওয়া যায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু পানীয় খেজুর গাছের রস। শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে বসে এই সুস্বাদু খেজুর গাছের রস খাওয়ার মজাই আলাদা। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে কদর বেড়ে যায় খেজুর গাছের। সারাবছর অবহেলিত খেজুর গাছগুলোকে ঝুড়ে নতুন রূপ দেন গাছিরা। গাছ থেকে রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি আর রস ও গুড়ের নানা শীতকালীন পিঠা তৈরির ধুম পড়ে আবহমান গ্রাম বাংলায়।
এরই ধারাবাহিকতায় গাজীপুর জেলায় কালিয়াকৈর উপজেলার আন্ধারমানিক এলাকায় অবস্থিত এফডিসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটিতে রস আহরণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে শীতকালীন মধুবৃক্ষ ২৭০টি খেঁজুর গাছ। এখানে ১০৫ একর আয়তনের সমস্ত জায়গা জুড়ে রয়েছে প্রায় চার শতাধিক ছোটবড় খেঁজুর গাছ। এসব গাছ থেকে প্রতিবছর শীতকালীন খেজুঁরের রসের চাহিদা মেটাতে তৈরি হয় রস ও খেজুরের গুড় উৎপাদন। এ বছরেও তার ব্যতিক্রম নয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফিল্মসিটির মূল ফটক থেকে শুরু করে লেকের দু'পাশের পাড়ে সারি সারি ছোটবড় প্রায় তিন শতাধিক খেজুর গাছ। এসব খেজুর গাছে কয়েকে মাস আগেই ৪ জন গাছি ও ৩ জন সহকারী অক্লান্ত পরিশ্রম করে গাছগুলো কেটে রস আহরণের উপযোগী করে তুলেছে। চলতি সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে রস উৎপাদন সহ বাজারজাত করণ ও গুড় উৎপাদনের কার্যকম। শিল্প বেষ্টিত এই অঞ্চলে এমন প্রাকৃতিক রসের যোগান সত্যি অকল্পনীয় মনে করছেন জন সাধারণ ।
খেজুরের রস পেতে হলে বেশ কিছু কাজ করতে হয়। প্রথমে হাতে দা ও কোমরে দড়ি বেঁধে খেজুর গাছে উঠে নিপুণ হাতে গাছের উপরিভাগের নরম অংশকে কেটে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হয় বাঁশের তৈরি নালা। আবার পাখিরা যাতে রস না খেতে পারে আর কোনো জীবাণু না ছড়াতে পারে, সে জন্য আবার জাল বিছাতে হয়। গাছের কাটা অংশ থেকে চুইয়ে-চুইয়ে রস এনে নল দিয়ে ফোটায় ফোটায় জমা হয় মাটির কলসিতে। ভোর থেকে সকাল ৮/৯টা পর্যন্ত গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে। দুপুর পর্যন্ত রস জাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। কেউ কেউ আবার গুড় থেকে পাটালি তৈরি করে বিক্রির জন্য। আবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রস সংগ্রহের জন্য গাছে গাছে কলস বাঁধা। এভাবেই ব্যস্ত সময় পার করছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটির রস সংগ্রহকারী গাছিরা।
একবার গাছ কাটার পর ২-৩ দিন রস পাওয়া যায়। রসের জন্য গাছ একবার কাটার পর ৫-৬ দিন বিশ্রাম দেওয়া হয়। কাটা অংশ রোদে শুকিয়ে গেলে আবার ওই অংশ চেছে রস সংগ্রহ করা হয়। আর এ কারণেই সাধারণত খেজুর গাছ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে কাটা হয়, যাতে সূর্যের আলো সরাসরি ওই কাটা অংশে পড়ে। খেজুর গাছ ৫-৬ বছরের হলেই গাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু করা যায়। দো-আঁশ ও পলি মাটিতে জন্মানো গাছে বেশি রস হয়। কার্তিক মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত রস আহরণ করা হয়। তবে যত শীত বেশি পড়ে তত রস বেশি হয়। গাছিদের মতে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০টি গাছের রস থেকে তৈরি হয় ৪০ কেজি গুড়। শীত বেশী পড়লে রস উৎপাদন হবে দ্বিগুণ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা হলে তারা জানান, এফডিসিতে প্রতিবছর খেজুরের রস পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকালে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে খেজুরের রস সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। সাধারণ গাজীপুরে তেমন খেজুরের রস পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে ভালো মানের খেজুরের রস পাওয়া যায়। এতে শীতে খেজুরের রসের চাহিদা মিটছে আমাদের। পাশাপাশি এখানে সম্পন্ন খাঁটি খেজুরের গুড় তৈরি করে যা আমাদের জন্য খুবই ভালো।রিজভী আহমেদ মিল্টন বলেন, আমি এখানে খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদনের জন্য ৬০ বিঘা জমি লিজ নিয়েছি। আশা করছি, এ এলাকার খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা মিটাতে পারব। আমি ন্যাচারাল ফুড উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করে থাকি। তাই আমি লিজকৃত জমি থেকে ফ্রেশ ও ভালো মানের খেজুরের রস ও গুড় মানুষের মাঝে উপহার দিতে চাই। এখানে ৪ শতাধিক খেজুর গাছ রয়েছে। এবছর প্রায় ৩ শতাধিক খেজুর গাছ রস উপযোগী করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে রস নামানো শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ৩০০ লিটার রস পাওয়া যায় । এই রস বিক্রি করা হয় ৬০ টাকা লিটার। বিক্রির পর অবশিষ্ট রস নিজেরাই সম্পন্ন প্রকৃতিক উপায়ে তৈরী হবে গুড়। আমি চাই বাজারে যে ভেজাল বা চিনি মিশ্রিত গুড় পাওয়া যায়, এটা থেকে বেড়িয়ে সাধারণ মানুষকে ভালো মানের খাঁটি গুড় খাওয়াতে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ