ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
মুক্তিযুদ্ধের গল্পগাঁথা

গেরিলা যোদ্ধা মিয়াব আলীর যুদ্ধজীবন

প্রকাশনার সময়: ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:০৬

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যুদ্ধাদের একজন মাধবপুরের মিয়াব আলী। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলন তিনি। ২২ বছরের টগবগে যুবক অস্ত্র চালাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের ক্যাম্পে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মিয়াব আলীর জীবন থেকে পিতা আব্দুল মালেক, মাতা ছায়েরা খাতুন, জীবনসঙ্গী ও বড় ছেলেকে হারিয়েও তিনি এখন সুখেই আছেন।

এক আলাপচারিতায় হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের মিয়াব আলী যুদ্ধে যাবার গল্প শোনান এই প্রতিবেদককে।

সেই ১৯৭১ সাল মাঠের জমিতে ধুম চলছিল জলি ধান বাইন (বানা)। সকাল পেরিয়ে দুপুরের সময় হঠাৎ সুলতানপুর গ্রামের ফসলের মাঠে পাক মিলিটারির আর্টিলারি গ্রুপ আসলো। গ্রামবাসী সকলে দৌঁড়াদড়ি শুরু করল। প্রাণ বাঁচাতে বাবা আবদুল মালেক, মা ছায়েরা খাতুন ও ৭ বছরের ছোট ভাই আবুল বাশারকে নিয়ে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে পঞ্চবটি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। বাবা মা ও ছোটভাইসহ সোনারাম শরণার্থী ক্যাম্পে রাত্রিযাপন করি। রাত পেরিয়ে সকাল হলে পরিবারের সবাইকে শরণার্থী ক্যাম্পে রেখে আমি সোনারাম থেকে পঞ্চবটি হয়ে কাতলামারা এলাকায় আসি।

কাতলামারা বাজারে এসে দেখা হয়ে যায়, সুলতানপুর গ্রামের আব্দুল আওয়াল চৌধুরী ও আদিউড়া গ্রামের দুলাল চৌধুরীর সঙ্গে। আব্দুল আওয়াল চৌধুরী আমাকে ২টি রুটি, সবজি ও চা খাওয়ায়। খেতে খেতে আমাকে প্রস্তাব দেয় আগরতলা গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। আমি লেখাপড়া না জানা মানুষ, কিভাবে আগরতলা যামু? আব্দুল আওয়াল চৌধুরী নিজের পকেট থেকে ১০ টাকা দিয়ে আমাকে আগরতলা পাঠিয়ে দেয়।

দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে বিকালে আমাকে আগরতলা কংগ্রেস ভবনে নিয়ে যায় দুলাল চৌধুরী। সারা দিন থাকার পর ইউথ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এক এক করে আমরা ৪৫ জনের একটি দল ইউথ ক্যাম্পে মিলিত হই। দুইদিন পর ময়মনসিংহের আরও ২ জন যুক্ত হলে ইউথ ক্যাম্পে আমরা মোট ৪৭ জন হই।

ওখানে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) ছিলেন এসএম মুসলিম, এড. মাহাম্মদ আলী পাঠান, জারু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন। ইউথ ক্যাম্প থেকে হাপানি এলাকায় গিয়ে তাবু নির্মাণ করি, সেখান থেকে উম্পিনগর রিক্রুট সেন্টারে গিয়ে ১৩ দিনের মত থাকি। উম্পিনগর থেকে গোকুলনগর নিয়ে মেডিক্যাল করানো হয়।

৪৭ জনের মধ্যে ২জন মেডিক্যালে আনফিট হলে পুনরায় ৪৫জনের দলটিকে বর্তমান নয়া দিল্লির পশ্চিমাংশে পালোটান ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে ১৫ দিন ট্রেনিং দেওয়া হয়। শিখ সৈন্যরা আমাদেরকে ট্রেনিং শেষে যুদ্ধকালীন সময়ে হজোমারায় ৩নং সেক্টরে আমাদের পাঠিয়ে দেয়। ওই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের কলাগাছিয়ায়।

হবিগঞ্জ, আখাউড়া ও ভৈরব এলাকা ছিল ৩ নং সেক্টরের আওতায়। ওই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর কেএম শফি উল্লাহ, ক্যাপ্টেন নাসিম, সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন কাজী কবির উদ্দিন ও হেলাল মুর্শেদ ছিলেন ওই সেক্টরের দায়িত্বে।

ইংরেজি মাসের নাম ভুলে গেলেও ২৬ তারিখ যুদ্ধ করার জন্য তার হাত তুলে দেওয়া হয়েছিল ১টি এসএলআর, ৪টি ম্যাগাজিন, এক্সট্রাগুলি ও ফিতা। অস্ত্র নিয়ে সেখান থেকে রাতেই বিশালঘর এলাকায় গিয়ে ব্যাংকার খুঁড়ে পশ্চিমমুখী হয়ে অস্ত্র তাক করে রাখি। ৩ দিন বিশালঘর থেকে আবার চলে আসতে হয়েছে ৩ নং সেক্টরের সাব সেক্টর সুদর টিলায়।

সেখান ফ্রিডম ফাঁইটার (এফএফ) বানিয়ে গাইডার ছিলেন বাঘাসুরা গ্রামের ছোয়াব আলী। গাইডার ছোয়াব আলীর সঙ্গে উচাইল গ্রামে গিয়ে ফজলু মিয়ার বাড়িতে অবস্থান করি। সেখান থেকে নাসিরনগরের লক্ষ্মীপুর, লাখাই, বুল্লা, বানেশ্বরে গেরিলা যুদ্ধ করি। বুল্লা গ্রামের সাত্তার মেম্বারের বাড়ীতে এসে মিত্র বাহীনির দেখা পাই। সেসময় আমাদের গাইডার ছিল ছিদ্দিক মিয়া। বানেশ্বর গ্রামে এক রাজাকারকে মারতে গিয়ে ওই রাজাকারের মা আমাকে দা দিয়ে খুব মারল। আমি অস্ত্রের বাট দিয়ে আটকিয়ে প্রাণ রক্ষা করি।

সেখান থেকে লাখাই গ্রামের জিরুন্ডা যাবার পর বুধবার দেশ স্বাধীন হয়েছে খবর পেয়ে অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য হবিগঞ্জের পোদ্দার বাড়ীতে যাই। আমার অস্ত্রে দায়ের কোপ দেখে জেনারল ওসমানী সাহেব অস্ত্র গ্রহণ করেনি। অস্ত্র দিয়ে জীবন বাঁচানোর বিষয়টি বললে জেনারল সাহেব আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদর করেন এবং অস্ত্রটি জমা নিয়ে আমাকে একটি কম্বল উপহার দেন।

দেশ স্বাধীনের পর ১৫ দিন ট্রেনিং নিয়েছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ২ বছর পর বিয়ে করে সংসার শুরু করি। রিক্সা চালিয়ে জীবন কাটিয়েছি। সংসার জীবনে ৪ ছেলে ছিল, ১৮ বছর আগে প্রিয়তমা স্ত্রী মারা যায়, ১০/১২ বছর আগে মারা গেছে বড় ছেলেটাও। বিএনপি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবমূল্যায়ন ছিল।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ৩শ টাকা সম্মানীভাতা চালু করেছিল। আজ আমি ২০ হাজার টাকা সম্মানীভাতা পাই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শেখ হাসিনা সম্মান করে বিল্ডিং ঘর বানাইয়া দিছে। শেখ হাসিনা সরকার আমাদেরকে খুশি ও সুখে রেখেছে।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ