ঢাকা, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কুয়েট শিক্ষকের মৃত্যু : হত্যাকারীদের ফাঁসি চান স্ত্রী

শিশু কন্যার প্রশ্ন; বাবা কখন আসবে?
প্রকাশনার সময়: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:২১ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৩৬

‘কী অপরাধ ছিল আমার স্বামীর। সে ভালোভাবে বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিল। আর অসুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। তারপরই সে মারা গেল। কেন আমার স্বামীকে অকালে জীবন দিতে হলো। আমার স্বামীর মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী আমি তাদের ফাঁসি চাই।’

সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতাদের মানসিক নির্যাতনে মৃত্যুবরণকারী খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট)’র ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনের স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা কান্নাজড়িত কণ্ঠে মঙ্গলবার এ প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে একথা বলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি চুয়াডাঙ্গায় বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন।

তিনি বলেন, ‘বাবা ছাড়া আমার ছয় বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস আনিকা ভাত খায় না। তাকে আমি কি করে বোঝাবো যে তোমার বাবা আর কখনো তোমাকে ভাত খাওয়াবে না। আর কখনো আদর করবে না। সে শুধু আমাকে প্রশ্ন করে ‘মা বাবা কখন আসবে? বাবা ছাড়া আমি ভাত খাব না।’ নার্সারিতে পড়ুয়া তার একমাত্র শিশু কন্যার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাও বলেন।

তিনি বলেন, ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তার মেয়েও টেলিভিশন দেখতে বসলেও প্রতি মুহূর্তে বাবার কথা বলছে। কোনভাবে তাকে সামলানো যাচ্ছে না।’ এ কারণে তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

ড. সেলিমের স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা অভিযোগ করে বলেন, তার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণে চুয়াডাঙ্গায় বাবা ও ভাইয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন। কিন্তু বিভিন্ন মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে একই ব্যক্তি তাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। কখনও বলছে, ‘যে অবস্থায় আছেন, সেই অবস্থায় এখনই মেয়েকে নিয়ে থানায় চলে আসেন, আবার বলছে এখনই মেডিকেলে চলে আসেন’। এমনকি কখনও ঢাকা, কখনও খুলনার কথা বলে বলা হচ্ছে, ‘আপনাকে রিমান্ডে নেয়া হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ কারণে শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে অপরিচিত নম্বর তিনি রিসিভ করা থেকে বিরত থাকেন। এর মধ্যে সর্বশেষ সোমবার আবারও তাকে ফোন করা হলে তার ভাই রিসিভ করেন। এ সময়ও উল্টা-পাল্টা কথা বলায় বিষয়টি থানা পুলিশে অভিযোগ করার কথা বলেন। বর্তমানে মেয়েকে নিয়ে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিষয়টি তিনি গোয়েন্দা সংস্থা ও কুয়েট শিক্ষক সমিতিকে জানিয়েছেন বলে জানান।

সাবিনা খাতুন রিক্তা ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সেদিন (৩০ নভেম্বর) দুপুরের আগে তিনি (ড. সেলিম) আমাকে ফোনে বলেন, তুমি রান্না করে রেখ। ১টা ১৫ মিনিটে ল্যাব আছে। কিন্তু তিনি সময়মতো বাসায় না ফিরে পৌনে ২টার দিকে আসেন।

তিনি বলেন, তার স্বামী ক্যাম্পাস থেকে ফিরে প্রথমেই মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতেন। কিন্তু সেদিন মেয়েকেও কোলে নেননি। তার চোখ-মুখ ছিল লাল। বিমূর্ষ চেহারা। কী হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অফিসে গিয়ে হল প্রভোস্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। আর তার চলে যাওয়ার পর থেকে শিশু মেয়ে শুধু সেই কথাই বলছে, ‘যে বাবা আমাকে কোলেও নিল না, আমার সঙ্গে কথাও বললো না’।

রিক্তা বলেন, এরপর তিনি গোসলের জন্য ওয়াশরুমে যান। কিছুক্ষণ পর তার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস আনিকা ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে বাবাকে ডাকে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া মিলছিল না। পরে আমি গিয়ে ডাকাডাকি করি। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। পরে আশপাশের লোকজনকে ডাকি। তারা এসে ওয়াশরুমের দরজা ভেঙে দেখা যায় তিনি অচেতন হয়ে দেওয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে আছেন। তাকে প্রথমে কুয়েট মেডিকেলে নেওয়া হয়। পরে সিটি মেডিকেলে। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, ড. সেলিম কুয়েটের লালন শাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা হল ডাইনিংয়ের ম্যানেজার পদে নিজেদের লোককে নির্বাচন করতে তাকে চাপ দিয়ে আসছিল। মৃত্যুর দুদিন আগেও ড. সেলিমকে ফোন করে কঠোর ভাষায় কথা বলেছিল ছাত্রলীগের এক নেতা।

সাবিনা খাতুন রিক্তা বলেন, মৃত্যুর ঠিক দুদিন আগে রাত ১০টার দিকে ড. সেলিমের ফোনে একটি কল আসে। এ সময় আমি ও আমার মেয়ে তার কাছেই ছিলাম। মোবাইল ফোনে অপর প্রান্ত থেকে খুব জোরে জোরে কথা বলা হচ্ছিল। তার কথা শুনে ড. সেলিমের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। পরে তিনি জানান, ছাত্রলীগের এক নেতা হল ডাইনিংয়ের ম্যানেজারের পদের জন্য চাপ দিচ্ছে। সর্বশেষ স্বামীকে ‘মানসিক নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে’ অভিযোগ এনে আইনগত পদক্ষেপের বিষয়ে ড. সেলিমের স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করুক। কিন্তু সোমবার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আমাকেই মামলা করতে হবে। তারা সব ধরণের সহযোগিতা করবে। এখন বিষয়টি পরিবারে আলাপ-আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিব। সিসি ক্যামেরায় যাদের দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে কুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর ড. কাজী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর আমরা পদক্ষেপ নেব। কমিটির প্রতিবেদন ও সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সব হবে।

খানজাহান আলী থানার ওসি (তদন্ত) শাহরিয়ার হাসান বলেন, পারিপার্শ্বিক বিষয় ও সাধারণ ডায়েরির আলোকে আমরা ড. সেলিম হোসেনের লাশ উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার স্ত্রীকে হুমকির বিষয়টিও আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি।

প্রসঙ্গত, সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ড. সেলিমকে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করে। আনুমানিক আধা ঘণ্টা শিক্ষকের কক্ষে অবস্থান করে তারা। সেখানে কুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে কিছু সাধারণ ছাত্রের জেরা, অপমান, অবরুদ্ধ করে রাখা ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। পরে শিক্ষক ক্যাম্পাস সংলগ্ন বাসায় যান। সেখানে দুপুর ২টার দিকে ওয়াশরুমে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন, পরে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় দুই দফা তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

শিক্ষক সেলিমের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে দোষীদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবিসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছে শিক্ষক সমিতি। এছাড়া তারা কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধেরও দাবি জানান।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ ৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া পাঁচ সদস্যের নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ