কুয়োর ধারে চলতো আড্ডা গ্রামের বধূরা মিলে/ আলাপ শেষে ফিরত বাড়ি কলস কোমরে তুলে। টাপুর-টুপুর কুয়োর পানির শব্দে মন যেত ভরে। নিজের ছবি ভাসতো তথায় দৃষ্টি পানিতে পড়ে। কবিতার পঙক্তির মত গ্রামবাংলায় অতি পরিচিতি ছিল পানির কুয়ো।
প্রাচীনকাল থেকেই কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে অঞ্চলে পান করার জন্য সুপেয় পানির অভাব ছিলো ব্যাপক। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। নব্বই দশক পর্যন্ত এ অঞ্চলের মানুষ তাদের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করত গভীর কূপ বা কুয়ো থেকে। তাই তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বিশেষ প্রয়োজন ছিলো এই কুয়োর স্বচ্ছ পানি। আঞ্চলিক ভাষায় এই কুয়োকে বলা হয় ইন্দারা। এই সুপেয় পানি পানের অভাব বোধ থেকে এই অঞ্চলের মানুষ খনন করতো গভীর কুয়ো বা ইন্দারা। খাল-বিল, নদী-নালা,পুকুর থেকে সংগ্রহ করতো ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় পানি।
কিন্তু সময়ের আবর্তনে এখন এ অঞ্চলের একমাত্র সুপেয় পানির উৎস কূপ বা কুয়োগুলো হারিয়ে বিলীন, যা এখন শুধুই স্মৃতি। গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় অথবা বাড়ি বাড়ি এখন আর কুয়ো দেখতে পাওয়া যায় না। অথচ কিছুদিন আগেও যেসব পাড়ায় বা বাড়িতে কুয়ো ছিল, এখন সেখানে টিউবওয়েল অথবা সাবমার্সিবল পাম্প রয়েছে। তাই নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই কুয়ো এখন অজানা।
সময়ের আবর্তনে অর্থনীতির চাকা গতিশীল হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে জনমনে। টিউবয়েল ও সাবমার্সিবল বাড়িতে থাকায় এখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পানিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। আর দেশব্যাপী শিল্পায়নের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনমানে যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে তাতে কিন্তু গ্রাম-বাংলার বুক থেকে হারিয়ে গেছে প্রাচীন ঐতিহ্যের একমাত্র সুপেয় পানির উৎস কুয়ো/ইন্দিরা।
আগে বিকেল বেলা গ্রাম-বাংলার প্রতিটি মা-বোনেরা সন্ধ্যে বেলায় কোমরে কলসি নিয়ে কুয়ো থেকে পানি আনত। কালের পরিক্রমায় এখন আর সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায় না। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শহরের মতো করে গ্রামাঞ্চলেও বৈদ্যুতিক মেশিনের সাহায্যে মাটির গভীর থেকে পানি তোলা হয়।
এদিকে হোসেনপুরে কিছু গ্রাম এলাকায় এখনও কুয়োর দেখা পাওয়া যায়। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার দ্বীপেশ্বর, কাওনা, রামপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনও কুয়ো দেখতে পাওয়া। কিন্তু সেগুলো এখন পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে আর আগের মতো ব্যবহার হয় না।
সরেজমিনে হোসেনপুর উপজেলার আড়াইবাড়িয়া গ্রামের মসজিদের একটি কুয়ো দেখা যায়। সেখানে কুয়োটি এখনও অরক্ষিত অবস্থায় আছে, টিউবওয়েল থাকার পাশাপাশি গ্রীষ্মকালে এই কুয়ো থেকে পানি তুলে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে শুধুমাত্র পানি পান করা ব্যতিত অন্যান্য সকল কাজে এ পানি ব্যবহার করা হয়।
এ সময় দ্বীপেশ্বর গ্রামের শতবর্ষী টুনু মুন্সি (১০২) জানান, ইন্দিরা পানি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু লাগতো। ঘরে রান্নাবান্না ধোঁয়া-মোছার কাজে আমরা ইন্দিরা পানির ব্যবহার করতাম। কিন্তু আজকাল এ টিউবলের পানিতে ওই রকম স্বাদ পাই না।
টুনু মুন্সির কথায় একমত হয়ে প্রবীণ বয়স্ক জেমস, কলিমুদ্দিন, সাহারা বানু জানায়, ইন্দিরার পানি অপরিষ্কার থাকলেও এটা অত্যন্ত ঠান্ডা থাকতো। গরমকালে পান করতে ভালো লাগতো। গ্রীষ্মকালে সাধারণত পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি নিচে নেমে যায়। দেশব্যাপী অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি নিচে নেমে গেলে টিউবওয়েল এবং সাবমার্সিবল পাম্প ও পড়ে যায় ঝুঁকির মধ্যে। চৈত্র খরতাপে গ্রামের অধিকাংশ কুয়োগুলো শুকিয়ে যেত। এ সময় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিত। মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুপেয় পানির জন্য ধীরে ধীরে কুয়োর পরিবর্তে টিউবওয়েল ও সাবমার্সিবলে উত্তোলনকৃত পানির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাই কালের বিবর্তে হারিয়ে যাওয়া কুয়ো ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মের কাছে কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে ।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ