ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নিভৃত পল্লী হুলহুলিয়া এখন দেশের মডেল গ্রাম

প্রকাশনার সময়: ৩০ অক্টোবর ২০২১, ১৩:৩৫

আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, সবুজ-শ্যামল, অপরূপ ও মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য। দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত যেন অনন্য প্রকৃতি। এ যেন এক রূপকথার গ্রাম। যেখানে শিক্ষার হার শতভাগ। নেই একজনও নিরক্ষর। অধিকাংশই উচ্চশিক্ষায় আলোকিত। এখানে নেই চুরি, ডাকাতি, মাদকের ছোবল বা ঝগড়া-বিবাদ। দুঃখে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো আর সুখে আনন্দ ভাগাভাগি করাই তাদের মূল বৈশিষ্ট্য।

এমন এক আদর্শ গ্রাম নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নের হুলহুলিয়া। অবাক করা তথ্য হলো, প্রায় শত বছরে এই গ্রামে কখনো পুলিশ আসার প্রয়োজন হয়নি।

জেলা সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা ও শান্ত এক গ্রাম হুলহুলিয়া। চলনবিলবেষ্টিত এ গ্রাম ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত। গ্রামের আয়তন প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। এই গ্রামে শিক্ষার হার ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ। গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ছয় হাজার, ভোটার সংখ্যা দুই হাজার ছয়শ। গ্রামে রয়েছে একটি মসজিদ, মন্দির, কওমী মাদ্রাসা, ডাকঘর, উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয়। এ উচ্চ বিদ্যালয়ে রয়েছে ছাত্র সংসদও।

১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। বন্যার পর গ্রামের অনেক চাষি ধানবীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে নিয়ে সভায় বসেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তারা বিনা শর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়েই গ্রামের উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪০ সালের ১লা জানুয়ারি গঠিত সেই পরিষদই আজ হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে প্রতিষ্ঠিত।

জানা যায়, হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে গ্রামের নিজস্ব ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। এ ছাড়া পাঁচজন উপদেষ্টা থাকেন কমিটিতে। দুই বছর পরপর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। গ্রামের পুরুষ ভোটারদের ভোটে এ পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদ গ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করে। গ্রামটিতে ২৫ বছর ধরে সর্বনিম্ন লেখাপড়া জানা মানুষটিকেও কমপক্ষে এসএসসি পাস করতে হবে। গ্রামটির কারো লেখাপড়ার খরচ বহন করার সামর্থ্য না থাকলে তাদের পরিষদ থেকে তা বহন করা হয়।

১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে বিচারক প্যানেল গঠিত হয়ে আসছে। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এই প্যানেল আলোচনার মাধ্যমেই তা মীমাংসা করে। বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত না হলে থানা বা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না কারোরই। আর বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা আছে বলে তারা পরিষদের ওপরই নির্ভর হন। এমন আস্থাই পরিষদের বড় সাফল্য বলে মনে করে গ্রামের বাসিন্দারা।

ব্রিটিশ আমল থেকে হুলহুলিয়া গ্রামে নিজস্ব ব্যবস্থা চালু আছে। এ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। গ্রামের বিচারব্যবস্থায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোঁড়ামির কোনো ঘটনা নেই। ১৮৬৯ সালে হুলহুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। কিন্তু উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর অনেকেই ঝরে পড়ত। পরিষদের উদ্যোগ আর গ্রামের মানুষের চেষ্টায় ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়।

গ্রামের সন্তান চিকিৎসকরা বিভিন্ন সময়ে বিনামূল্যে গ্রামবাসীকে চিকিৎসা সেবা দিতে আসেন। ১৯৪৪ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয় গ্রামে। এই ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি এই ক্লাব পরিচালনা করে। হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে ‘শিকড়’ও ‘বটবৃক্ষ’নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকুরীজীবী। তাদের অনুদানে গ্রামের অভাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারদের কর্মসংস্থান করা হয়।

গ্রামের সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতন। এর প্রতিফলন দেখা যায় এই গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা মেধাবীদের পরিসংখ্যান দেখে। গ্রামে রয়েছে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, আইনবিদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু থেকে নিজেদের মেধা, অর্থ ও শ্রম দিয়ে গেছেন এ গ্রামের কৃতি সন্তানেরা। তবে যাদের ভোলার নয়, তারা হলেন শিক্ষাবিদ মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা, মরহুম মফিজ উদ্দিন, মরহুম ফরিদ উদ্দিন শাহ, আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক মরহুম হানিফ উদ্দিন মিয়া, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব মরহুম এ কে তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এম এম রহমত উল্লাহ প্রমুখ। তন্মধ্যে হানিফ উদ্দিন মিয়া ছিলেন দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। ১৯৬৪ সালে তার হাত ধরেই দেশে প্রথম কম্পিউটার আসে। তিনি ১৯২৯ সালের ১লা নভেম্বর সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

২০১৬ সালে জেডটিইর আর্থিক সহযোগিতায় ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে হুলহুলিয়া গ্রামে একটি ‘হুলহুলিয়া ডিজিটাল হাব’স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ১১টি কম্পিউটার, ১টি প্রজেক্টর, একটি ৭২ ইঞ্চি লাইভ টিভি, দুটি ওয়াই-ফাই জোন ও বিটিসিএল লাইন স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলাকাবাসীর নিজস্ব অর্থায়নে ৬৬ শতাংশ জায়গার উপর হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের দ্বিতল ভবনটি প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়। এতে রয়েছে একটি বিচার কক্ষ, নিম্ন আদালত, পাঠাগার, কমিউনিটি সেন্টার ও গেস্ট হাউজ।

এ বিষয়ে হুলহুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি আলহাজ্ব মো. আনিছুর রহমান বলেন, গ্রামের সবাই শতভাগ শিক্ষিত। সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতন। আমাদের গ্রামে প্রায় ১০০ বছর ধরে আজ পর্যন্ত কোনো পুলিশ আসেনি এবং কোনো মামলা থানায় যায়নি। যতদূর সম্ভব আমরা সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে সব সমস্যার মীমাংসা করি। কোনো কারণে যদি কেউ বিচারে অনিচ্ছা প্রকাশ করে, তবে তিনি ৩০ দিন পর আদালতে যেতে পারেন। তবে গ্রামের ঊর্ধ্বে কেউই নই। আমাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে গ্রাম পরিচালনা করে গেছেন, অদ্যবধি আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি পূর্বের ঐতিহ্য রাখতে। আমরাও আমাদের সন্তানদের এই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছি, যাতে তারা সমাজের বন্ধনটা ধরে রাখতে পারে।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল তৌফিক পরশ বলেন, আমাদের গ্রামে যদি কোনো ঝগড়াবিবাদ হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের গ্রামের নিজস্ব বিধিবিধান আছে, সেখানে মীমাংসা করে ফেলি। আমাদের থানা বা কোর্টে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। গ্রামের মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়। শতভাগ শিক্ষিত গ্রাম হওয়ায় এখানে নেই কোনো বাল্যবিবাহ এবং গ্রামে আমাদের একটি আইসিটি হাব আছে, যা আমাদের গ্রাম ডিজিটালাইজড করার জন্য ভূমিকা রাখে। আমরা মাঝেমধ্যে গ্রাম উন্নয়ন পরিষদের অর্থায়নে বিভিন্ন রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার করে থাকি।

চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম ভোলা বলেন, এই গ্রামের মানুষ শতভাগ শিক্ষিত। তাঁদের কোনো বিচার করতে হয়না, সকল বিচার নিজেরাই করে। নিজস্ব সংবিধানে তারা চলে। যা বাংলাদেশে দূর্লভ।

সিংড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নূর-এ-আলম সিদ্দিকী জানান, এ গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্যান্য এলাকার চাইতে সন্তোষজনক। সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এম এম সামিরুল ইসলাম বলেন, আমি শুনেছি, প্রায় শতবর্ষের ইতিহাসে হুলহুলিয়া গ্রামে কোনো ধরনের মামলা মোকদ্দমা নেই। নিজস্ব সংবিধানে পরিচালিত হয়। গ্রামেই বিচার সালিশ হয়। বাস্তবতার আলোকে এটি সত্যিই বিস্ময়কর এক গ্রাম। সারাদেশের হানাহানি, মারামারি, বিরোধের মধ্যে হুলহুলিয়া গ্রাম যেন এক শান্তির ভূখণ্ড।

নয়া শতাব্দী/ টিএফ/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ