স্ত্রী জাহেদা বেগমের ওপর অভিমান করে বাড়ি ছেড়েছিলেন বাচ্চু মণ্ডল (৬৪)। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার পলাশপুর থেকে এসেছিলেন যশোরের অভয়নগরে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি)। সেখান থেকে ২৮ বছর পর আবার বাড়ি ফিরেছেন বাচ্চু মণ্ডল। মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় অভয়নগরের সুন্দলী ইউপি চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিলের মধ্যস্থতায় ইউপি সদস্য, সাংবাদিক ও সুধীজনদের উপস্থিতিতে পরিবারের কাছে তাকে তুলে দেওয়া হয়।
এতদিন পর পরিবারের সদস্যদের কাছে পেয়ে এবং বাড়ি যাওয়ার আনন্দে বাচ্চু মণ্ডলের চোখে-মুখে ছিল উচ্ছ্বাস। ওই দিন রাতেই বাসে করে ভাইপো শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যশোর থেকে পলাশপুর বাড়ির পথে রওনা হন তিনি।
বাসে ওঠার আগে স্ত্রী জাহেদা বেগমকে মুঠোফোনে বাচ্চু মণ্ডল বলেন, ‘বউ কেমন আছিস, আমার ছেলে কেমন আছে, আমি আর রাগ করে নেই, আমি বাড়ি আসছি। ’
অভয়নগরে বাচ্চু মণ্ডলের ২৮ বছর : এ বিষয়ে সুন্দলী ইউপি চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বলেন, বাচ্চু মণ্ডলের পরিবার আছে-এমন কথা তিনি কোনো দিন কাউকে বলেননি। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তিনি আমাদের ইউনিয়নে রয়েছেন। স্ত্রীর ওপর অভিমান করে ৩৬ বছর বয়সে বাচ্চু মণ্ডল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন।
বিভিন্ন যানবাহনে করে তিনি যশোর মণিহার সিনেমা হলের সামনে আসেন। সেখান থেকে অভয়নগরের নওয়াপাড়া বাজার হয়ে সুন্দলী ইউনিয়নের সুন্দলী বাজারে পৌঁছালে রাত হয়ে যায়। এরপর রাতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বাজারে পাশে আড়পাড়া গ্রামের নগেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে তিনি যান।
সেখানে কয়েকদিন থাকার পরে খাওয়া-থাকার শর্তে তার কৃষি জমি ও বাড়ির কাজ করেন বাচ্চু মণ্ডল। ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মুকুন্দ মল্লিকের বাড়িতে দুই বছর থাকার পর একই গ্রামের চারু মল্লিকের বাড়িতে চলে যান। অপরিচিত মানুষ এলাকায় বসাবস করছে জানতে পেরে সুন্দলী ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান বিকাশ মল্লিক তাকে একদিন পরিষদে ডাকেন।
এরপর তার জীবিকা নির্বাহ করার জন্য ২০০৬ সালের দিকে চেয়ারম্যান বিকাশ মল্লিক ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বাচ্চু পরিবহন লেখা একটি ভ্যান উপহার দেন। যে ভ্যান চালিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। সেই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে বসবাস করার সুযোগ করে দেন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা।
সেই থেকে বাচ্চু মণ্ডলের ঘরবাড়ি সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদ। এখানেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়েছেন। অবশেষে পরিবার তাকে সন্ধান করলে মঙ্গলবার রাতে তাদের কাছে বাচ্চু মণ্ডলকে তুলে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই ইউনিয়নেই তার বসবাস। ফলে পরিষদটি হয়ে ওঠে তার পরিবার।
এলাকায় সবার কাছে প্রিয় ‘মণ্ডল ভাই’ বা ‘বাচ্চু ভাই’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। বাচ্চু মণ্ডল চলে যাওয়ার ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আয়া কর্মচারীরা সকই একদিকে যেমন খুশি, অন্যদিকে আবেকে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন। খুব ভালো মনের মানুষ তিনি। তবে ২৮ বছর পর মানুষটিকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান।
বাচ্চুর ভাইপো শফিকুল ইসলাম বলেন, চাচি অন্তঃসত্ত্বা থাকতে চাচা নিখোঁজ হয়েছিলেন। চাচা নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। একপর্যায়ে চাচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সম্প্রতি আমাদের এলাকার গ্রাম পুলিশ অসিত বিশ্বাসের মাধ্যমে চাচার সন্ধান পাই। বর্তমানে জাহিদুল ইসলাম নামের ২৭ বছরের একটি ছেলে আছে চাচার।
শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিলের মধ্যস্থতায় ওই দিন রাতেই চাচাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। পরের দিন সকালে বাড়িতে আসি। দীর্ঘদিন পর চাচা বাড়িতে আসায় আমাদের সবার পরিবারে আনন্দ বিরাজ করছে। আমার দাদা-দাদি বেঁচে থাকলে আরও খুশি হতেন।
গ্রামে বাচ্চু মণ্ডলকে দেখতে অনেকেই ভিড় করছে বলেও জানান তিনি।
সুন্দলী ইউনিয়ন থেকে বিদায়ের সময় কাঁদছিলেন বাচ্চু মণ্ডল। বলেছিলেন, আমার মা-বাবা দুজনের কেউ বেঁচে নেই। চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সেজ। স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-বন্ধুদের ফেলে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আমি সনাতন ধর্মের মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছি। তারা আমাকে তাদের ভাই হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছে। থাকতে দিয়েছে, ভালো খেতে দিয়েছে, ভালো ব্যবহার করেছে।
তিনি আরও বলেন, আমি সুন্দলী ইউনিয়নবাসীর কাছে ঋণী। বাড়ি ফিরে গেলেও মনের টানে অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়নে স্বপরিবারে বেড়াতে আসব।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ