গুড় শিল্পে নতুন উদ্ভাবন ‘তোগুড়’! তরমুজের রস দিয়ে তৈরি এই গুড়। প্রথমবারের মতো তরমুজের রস দিয়ে পরীক্ষামূলক তোগুড় উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ছোটবন্ড গ্রামের কৃষক মত্যুঞ্জয় মণ্ডল। সুঘ্রাণ ও মিষ্টি এই গুড়ের নাম দিয়েছেন ‘তোগুড়’। অর্থাৎ তরমুজ থেকে যে গুড় হয় তার নামই তোগুড়।
এতোদিন তোগুড়ের নাম কেউ শোনেনি। না শোনারই কথা। কারণ এর আগে সবাই খেজুর, আখ আর তালের গুড় খেয়েছে। কিন্তু তরমুজের আবার গুড় কীভাবে হয়? এমন প্রশ্ন সকলের মনেই। সেই তোগুড় উৎপাদন তৈরি করেছেন মত্যুঞ্জয় মণ্ডল।
তরমুজ থেকে গুড় তৈরির পরিকল্পনা মাথায় আসলো কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তরুণ কৃষক মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল জানান, দীর্ঘদিন ধরে তরমুজের চাষ করছি। তরমুজ চাষে সফলতাও পেয়েছি। চাষ করতে গিয়ে দেখি, প্রতি মৌসুমেই কিছু কিছু তরমুজ সাইজে ছোট হয়। ছোট আকৃতির এই তরমুজ ‘ক্যাট’ নামে পরিচিত। এই তরমুজ বিক্রি করা যায় না। এগুলো অনেক সময় মাঠেই থেকে যায়। কোনো কোনো সময় বৃষ্টিতে এই তরমুজ পচে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। আবার কিছু কিছু ‘ক্যাট’ মাছ ও গবাদী পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একদিন হঠাৎ মনে হলো-খেজুর ও তালের রস থেকে গুড় হয়, তাহলে তরমুজের রস থেকে কেন গুড় হবে না? এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার মোসাদ্দেক হোসেনের পরামর্শ নিই। কিছুদিন আগে আমি ও আমার স্ত্রী বিক্রয়যোগ্য নয় এমন ছোট আকারের তরমুজ দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে গুড় উৎপাদনের চেষ্টা করি। ২০/২৫ কেজি তরমুজ থেকে ৫/৬ কেজি পরিমাণ নির্যাস (রস) হয়। সেই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করি। প্রথম দফায় সফলতা আসে। এই গুড় দেখতে খেজুরের গুড়ের মতোই। খুব মিষ্টি ও খেতে মধুর মতো।
তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত ১০/১২ কেজি গুড় তৈরি করেছি। কৃষি কর্মকর্তা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যকে দিয়েছি। পাড়া-প্রতিবেশীদেরও দিয়েছি। আর কিছু গুড় ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রিও করেছি। চাহিদা রয়েছে। অনেকেই গুড় কিনতে চেয়েছেন।
মৃত্যুঞ্জয় ছোট আকারের তরমুজ (ক্যাট) নিয়ে কোনো রকম মেশিন ছাড়া একেবারে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তোগুড় উৎপাদন করছেন। মৃত্যুঞ্জয় বলেন, এ বছর তেমন ক্যাট নেই। ফলে গুড়ও বেশি হবে না। তবে ভবিষ্যতে এই ক্যাট দিয়ে প্রচুর পরিমাণে গুড় উৎপাদনের ইচ্ছা আছে। গুড়ের দামও ভালো পাবো বলে আশা করছি।
মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রী মিতালী মণ্ডল বলেন, তরমুজ কেটে মিষ্টি লাল অংশ বের করতে হয়। সেই লাল অংশটুকু থেকে রস বের করতে হয়। পরে নেট দিয়ে ছেকে জুস বের করে চুলায় জ্বালাতে হবে। জ্বালাতে জ্বালাতে এক সময় রস গাঢ় হয়ে আসবে। তখন উপরে এক ধরনের ফ্যানা তৈরি হয়। সেই ফ্যানা উপর থেকে উঠিয়ে ফেলে দিতে হয়। আরও কিছুক্ষণ জ্বালালে রস গুড়ের রং ধারণ করে। তখন বোঝা যায় গুড় তৈরি হয়ে গেছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, খুলনা যেহেতু উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকা। এখানের জমি তরমুজ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তিনি বলেন, ডুমুরিয়ায় এই প্রথম তরমুজ দিয়ে গুড় তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন কৃষক মৃত্যুঞ্জয়। এটি কৃষিক্ষেত্রে দারুণ এক অর্জন। দেশের গুড় শিল্প দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। একদিকে তাল আর খেজুর গাছের সংখ্যা অপর দিকে গাছির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে, গুড় শিল্প হুমকির দিকে চলে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে তরমুজের গুড় দেশের গুড়ের চাহিদা মেটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
তিনি বলেন, মৌসুমের সময় কৃষক ন্যায্যমূল্য পায় না। আবার ছোট তরমুজও (ক্যাট) বিক্রি হয় না। বাণিজ্যিকভাবে তরমুজ দিয়ে গুড় তৈরি করলে কৃষক একদিকে যেমন তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যয্য মূল্য পাবে, অন্যদিকে ফসল অপচয় রোধ হবে। এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, তরমুজের গুড়ের গুণগতমান খুব ভালো। খেতেও খুব সুস্বাদু। বর্তমানে এই গুড় ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ